পথ ----- ১০ ----------------- হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি থেকে প্রথম পালাই বারো বছর বয়সে। না, কারও ওপর রাগ করে নয়। কাউকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্যেও নয়। এমনি। আমি যে পালিয়ে যাচ্ছি সেটাই তো জানতাম না। সেদিন ছিল শনিবার। নীলেন্দু পাল বলে আমার এক বন্ধু ছুটির পর আমাকে বললো, " আমাদের বাড়ি যাবি? " আমি তো একপায়ে খাড়া। তাই আর একটুও দেরি না করে বন্ধুর হাত ধরে টান দিলাম। এর আগে বন্ধুর মুখে তার বাড়ির গল্প শুনেছি। সেইসময় ওদের বাড়ি মহামায়া গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে ছিল। তারপরে আর কোনো বাড়ি নেই। ধূ ধূ করছে মাঠ। মাঠের একদিকে একটা বড় আমবাগান ছিল। ওই আমবাগানে কত ধরনের যে আম হতো তা বলে শেষ করা যাবে না। আমবাগানের ভেতরটা এমনই অদ্ভুত ভাবে সাজানো ছিল যে, সেখানে একবার পৌঁছালে মনে হতো যেন পৃথিবীর বাইরে কোথাও এসেছি। এইসব গল্প শুনে বন্ধুর বাড়ি সম্পর্কে আমার একটা টান তৈরি হয়েই ছিল। তাই বন্ধু বলতে আমি আর না করি নি। বন্ধুর বাড়ির ছবি আমি কল্পনায় অদ্ভুত রঙে এঁকেছিলাম। এটা আমার চিরকালের অভ্যাস। গল্প শুনে শুনে নিজের মনে ছবি আঁকা। অনেকটাই মিলে গিয়েছিল। যেটুকু মেলেনি সেটা হল বন্ধুর বাড়ির সামনে দিয়ে যে পথটা চলে গেছে সেটা দিগন্তে মিশে যাবার আগে অদ্ভুত একটা বাঁক নিয়েছে। সে এক অসাধারণ ছবি। ছাতা নেওয়ার অভ্যাস আমার কোন কালেই ছিল না।আজও নেই। তাই গ্রীষ্মের রোদ মাথায় নিয়ে বন্ধুকে সামনে রেখে এগিয়ে চললাম। মাটির পথ ধরে যেতে যেতে চারপাশের জিনিসপত্র সব গোগ্রাসে গিলছি। পথের পাশে কল থেকে দুজনেই জল খেলাম। তারপর আবার হাঁটা। বাড়িতে পৌঁছেই আর এক মিনিটও অপেক্ষা নয়। সোজা আমবাগানে। সত্যিই যেন এক অন্য পৃথিবী। আমবাগান থেকে বেরিয়ে আমি বন্ধুকে বললাম ওই বাঁকের মুখে যাব। এইরকম বাঁকের প্রতি টান আমার চিরকালের। বাঁকের আগে দাঁড়িয়ে আমার কেবলই মনে হতো এই বুঝি আড়াল থেকে কেউ বেরিয়ে এল। প্রায় চারটের সময় বন্ধুর বাড়ি ফিরলাম। চাষীর বাড়ি আমার খুব পছন্দের। একটা অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে থাকে সারা বাড়ি জুড়ে। বন্ধুর বাড়িতেও সেই গন্ধটা পেলাম। খেয়ে একটু শুয়েছি। হঠাৎ যেন মনে হল আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। প্রায় সাথে সাথেই বন্ধুর মা ঘরে ঢুকে বললো, "দ্যাখ তো বাবা, তোকে কে ডাকছে।" আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এই অচেনা জায়গায় আমাকে আবার কে ডাকবে! বাইরে বেরিয়ে দেখি, আমার মেজ জ্যাঠার ছোটো ছেলে। এই প্রথম আমার বাড়ির কথা মনে পড়ল।সাথে সাথে এটাও মনে পড়ল আমি বাড়ির কাউকে বলে এখানে আসি নি। বুঝতে পারলাম বাড়িতে ফিরে দিদির হাতে ভয়ঙ্কর মারের হাত থেকে আমাকে আজ কেউ বাঁচাতে পারবে না। সন্ধ্যেবেলা যখন ফিরলাম ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে আমি হারিয়ে গেছি। দিদি খুব মেরেছিল। রাতে শুতে যাওয়ার সময় মা শুধু বলেছিল, " বাড়ির কথা তোর একবারও মনে পড়ল না!" আমি মাকে বোঝাতে পারি নি, বলতে পারি নি আমার কোনো দোষ নেই। পথ আমায় সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। *******************
হরিৎ:30/05/2017