পথ ------ ২৮ ----------------- হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যজমানি করেই বাবার সংসার চালানো। আমি তখন খুব ছোটো। গত শতকের সাতের দশকের কথা। তখন পুজোর দক্ষিণা বলতে পঁচিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সা। এই পয়সা জড়ো করেই আমাদের দিন গুজরান হত। আমার বাবা মানুষটা ছিল এক অদ্ভুত। আমার চারপাশে ঘুরলেও আমি তাকে ছুঁতে পারতাম না। এক অদ্ভুত আদর্শ নিয়ে তার পথ চলা। বাবা রাতে শুতে যেত দেড়টা থেকে দুটো নাগাদ। খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ত। সকালের প্রথম চা-টা বাবাই করত। নিজে খেত আর সবাইকে দিত। এর জন্য যতক্ষণ অপেক্ষা করার করত। দুপুরে নিত্য পুজো সেরে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে দুটো। এসেই ভাত খেত না। একমুঠো মুড়ি খেয়ে পুঁথি লিখতে বসতো। ঘড়ি পড়তও না আর সামনে থাকলেও ভুলেও তাকাত না। বেলা চারটের সময় ভাত খেত। কি ভীষণ অভাবের মধ্যে দিয়ে তার পথ চলা। অথচ বাবাকে দেখে বোঝে কার সাধ্য। আমি দেখেছি, বাবা যখন ঘুমিয়ে থাকত তখন মুখে কী অদ্ভুত প্রশান্তি। দেখে কে বলবে মানুষটার এত অভাব। অদ্ভুত এক নিরাসক্ত জীবন ছিল বাবার। কারও সাথেই প্রায় কথা বলতো না। নিজের কাজ নিয়ে থাকত। আমাদের গরু ছিল। গরুর সব কাজ বাবাই করত। আমি জ্ঞানত কখনও দেখিনি বাবা কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করছে। বাবা বলতো ----- " যে যেমন চোখে পৃথিবীকে দেখে, সে সেই ভাবেই পথ চলে। কোনো কিছু সম্পর্কে মন্তব্য করার আমরা কে? " বাবাকে দেখেই শিখেছি নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। পাড়ার যে ঘাটে সবাই স্নান করতো, বাবা সেই মূল ঘাট থেকে সরে গিয়ে একটু দূরে অন্য ঘাটে স্নান করতো। বুঝতে পারতাম বাবার সবটাই তার নিজের মতো। খুব স্বাধীনচেতা মানুষ ছিল। কষ্ট হলেও সংসারে দাঁড়িয়ে একা লড়াই করতো। কখনও কারও কাছে হাত পাততে দেখি নি। সংসারের মানুষজনদের চাহিদা যতটা পারত মেটাবার চেষ্টা করত। আরও একটা জিনিস বাবার মধ্যে দেখতাম, সংসারের অভাব সংসারের মানুষজনদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতো না। সংসারের ছেলেমেয়েরা দেখুক তারা কি অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। সংসারের প্রকৃত অবস্থাটাই যদি সে না জানে তাহলে সংসারের জন্য সে ভাববে কিভাবে? বাবার পুঁথিগত বিদ্যা বলতে ক্লাস এইট। অথচ জীবন পথে চলতে চলতে তাকে যা সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি তা অতি শিক্ষিত ব্যক্তিকেও হার মানায়। এটাই তো জীবন শিক্ষা, যে শিক্ষায় বাবা ছিল অতি শিক্ষিত।
হরিৎ~ 01/07/2017
******************