Home ব্লগবাজি পথ —- ৩৯

পথ —- ৩৯

পথ —- ৩৯
পথ —— ৩৯
——————
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
     মা টাকা পয়সা চিনতে পারলেও গুণতে পারত না। কোনো কিছু জিনিস আনতে দিলে মা তার আঁচল থেকে খুলে পয়সাগুলো আমার হাতে দিয়ে দিত। বলত জিনিস আনতে যা দরকার তা যেন ওখান থেকে নিয়ে নিই। দরকার মতো পয়সা নিয়ে বাকি পয়সা মাকে দিয়ে দিতাম। মা আবার তা আঁচলে বেঁধে রাখতো।
     আমি জ্ঞান হওয়া থেকে দেখছি আমাদের বেশ কয়েকটি গরু আছে। বাবা যজমানি করে যা পেত, বাকিটা গরুর থেকে নিয়ে খুব কষ্টে সংসার চলতো। দুধ বেচে আমার পড়ার খরচ চলত। মা নিজে হাতে ঘুঁটে দিত গোয়াল ঘরের দেওয়ালে। শুকিয়ে গেলে আমি হাত লাগাতাম। দেওয়াল থেকে ঘুঁটেগুলো খুলে আমি রোদে দিতাম। শুকিয়ে গেলে মা ঘুঁটেগুলো গোয়াল ঘরের মাচায় তুলে রাখত।
     কত মানুষ যে মায়ের কাছ থেকে ঘুঁটে নিতে আসতো। তাদের দেখা মিলতো বিকেলবেলা। মা এইসময়ই আসতে বলত। কারণ সকালে আসতে বললে তো আর গল্প হবে না। তাই তারা বিকেলে উঠোনে ঝুঁড়ি নামিয়ে রেখে দুয়ারে বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করত। মা তাদের চা খাওয়াতো। গল্প করতে করতেই মা তাদের প্রত্যেকের ঝুঁড়িতে ঘুঁটে গুণে গুণে রাখত। মা সন্ধ্যে দেওয়ার জন্য উঠে পড়লে তারাও ঘুঁটে নিয়ে বাড়ি চলে যেত।
     ঘুঁটে বিক্রি করে পয়সা মা আঁচলে বেঁধে রাখত। মায়ের পয়সা রাখার কোনো জায়গা ছিল না। এমন কতবার হয়েছে ঘুঁটে বিক্রি করে পয়সা এমন জায়গায় রেখেছে পরে আর মনে করতে পারে নি। আবার কোনো কোনো সময় মা আঁচলে “হারা কার্তিক”-এর ( কিছু হারিয়ে গেলে মা এই ঠাকুরের নাম করে আঁচলে গিঁট বাঁধত ) গিঁট বেঁধেও পয়সা পেয়ে যেত।
     বাবার যখন পুজো থাকতো না তখন ঘুঁটে, দুধ বিক্রি করে মা অতি সামান্য যে পয়সা জমাতো সেগুলো বাবার হাতে তুলে দিত। কখনও রেশন থেকে কেরোসিন তেল তুলে আনত। রাতে নিজেদের ঘরে হ্যারিকেন জ্বালার থেকেও মায়ের বড় চিন্তা ছিল আলোর অভাবে আমার পড়াশোনা যেন বন্ধ না হয়।
      জমানো পয়সা দিয়ে মাকে কখনও দেখিনি নিজের জন্য কোনো জিনিস কিনছে। নিজের কোনো চাহিদাই ছিল না। কারও কাছ থেকেই কোনোদিন কিছু প্রত্যাশাও করত না। বাড়ির মধ্যে আমাদের সকলকে নিয়েই তার জীবন কেটে গেছে। ন’মাসে ছ’মাসে এক আধবার দেখতাম মা কাকিমা জেঠিমাদের সাথে সিনেমায় গেছে। জীবনে একবার মাত্র কলকাতায় গিয়েছিল। সেই কলকাতার গল্পই মা সারাজীবন ধরে আমাদের সকলকে শোনাত। হাওড়া ব্রিজের আকার, কত কত লোক, গাড়ি,   চিড়িয়াখানায় পশু পাখি, মেয়ে জামাই নাতনিকে নিয়ে আইসক্রিম খাওয়া —— সেই এক গল্প মা বলে যেত। আর কোনোদিন যেতে চায় নি। বুঝতে পারতাম কলকাতাকে দেখে মায়ের ভালো লাগা কতখানি। তবুও দ্বিতীয়বার দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে নি। এইভাবেই তৈরি হয়েছিল মানুষটা।
     জীবনে কখনও দেখিনি বাবা মায়ের জন্য কোনো কাপড় কিনে এনেছে। পুজো করে বাবা যে কাপড়গুলো পেত সেগুলোই মা খুশি মনে পড়ত। পুজোর সময় কত মানুষ কত কিছু নতুন পড়ে। মাও পড়ত কিন্তু সেগুলো বাবার কিনে দেওয়া নয়। যজমানেরা পুজো উপলক্ষে মাকে কাপড় দিত, ওগুলোই মায়ের পুজোর কাপড়। মা সেগুলো খুশি মনে লোকের কাছে গল্প করত। চোখে মুখে কত খুশি।
     আমি বরং মাঝে মাঝে মাকে বলতাম, ” নিজের জন্য কিছু কিনতে ইচ্ছা করে না?” মা উত্তর না দিয়ে শুধু হাসত। বলতাম, “বাবা তো তোমার জন্য কোনোদিন কিছু কিনে আনে না। তোমার রাগ হয় না?” একথাতেও মা খুব হাসত। তবে উত্তর দিত —— “তোর বাবার কাছ থেকেই তো শিখেছি নিজেকে কি করে ভুলে যেতে হয়। সকলকে নিয়েই ভাবতে হবে। দেখিস না, মানুষটা নিজের জন্য কোনোদিন একটা তিলমাত্র কিছু করল না, অথচ মনে মনে কত খুশি।” আমার আর কিছু মুখে আসত না। শুধু দেখতাম দুটো মানুষ আমাদের মধ্যে থেকেও মনে মনে কোন উচ্চতায় উঠে যাচ্ছে।
                          ********************

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here