অচেনা রঙ: সুদাস ভট্টাচার্য্য

অচেনা রঙ: সুদাস ভট্টাচার্য্য

অচেনা রঙ ।।

সুদাস ভট্টাচার্য্য (২০/০৩/২০১৭)

দোকানটা লক্ষ্য করি নি কোনদিন । আগে ছিল কিনা মনে পড়ল না । দোলের আগের দিন ছেলে মেয়ে এবং আমাদের জন্য আবির আর রঙ কিনতে গেছি । গড়িয়ার মোড়ে সার দিয়ে প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া অস্থায়ী দোকান । এর একটা থেকেই প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করি । খুব একটা ঘোরাঘুরি করি না , তাই হয়ত চোখে পড়ে নি । অবশ্য চোখে পড়ার কথাও নয় । হরেক রকম আবির পিচকারি রঙের পসরা সাজান দোকানগুলোর ফাঁকে এক চিলতে সরু গলি । সামনে নয় , গলির একপাশের দেওয়ালে একটা ব্যানার ঝুলছে “ সত্যিকারের রঙ খেলতে হলে ভেতরে আসুন ” ।

ব্যানারের অদ্ভুত বিজ্ঞাপনই দৃষ্টি আকর্ষণ করল । সত্যিকারের মানে ? বাইরের দোকান গুলোয় কি আজেবাজে রঙ বিক্রি হচ্ছে না কি ! আমি তো প্রত্যেকবার বাটার সামনের দোকানগুলো থেকেই রঙ আর আবির নিয়ে যাই । যাদবপুরের ফুলের নির্যাস থেকে নামী কোম্পানি – সব রকমই পাওয়া যায় । অন্তত: এত বছর অভিযোগ করার মত কোন ঘটনা ঘটে নি । ভাবলাম গলির ভেতরে বলে বিক্রি বাড়ানোর একটা কৌশল । দেখে আসা যাক । দু কথা শুনিয়েও আসা যাবে

– মশাই ব্যবসায় চমক আনতে আজে বাজে কথা লিখে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কি দরকার ?

গলিটা বেশ লম্বা আর সরু । আধো অন্ধকারে ভাল করে কিছু দেখা যাচ্ছে না । বেশ কিছুটা দূরে কয়েকটা আলোর মালা জ্বলছে নিভছে । মাঝামাঝি গিয়ে মনে হল দুত্তোর ! সব ভাঁওতা । আর গিয়ে কাজ নেই , ফিরে যাই । কিন্তু তখন একটা জেদ চেপে গেছে । ব্যাপারটা কি সেটা না দেখলে শান্তি পাব না । পেছন ফিরে দেখি আমি ছাড়া কেউ আর ঢোকেনি এ গলিতে । ঢুকবেই বা কেন ? আমার মত কারো হাতে এত সময় কোথায় ? হাতের সামনে যখন সব পাওয়া যাচ্ছে তখন এই অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে গলিতে ঢুকে হবে টা কি ? মনে মনে এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি খেয়াল করি নি । গলির শেষে ডানদিক ঘেঁসে একটু চওড়া জায়গা । সেখানে কাঠের র্যা কে সোনালী রঙের বাটিতে থরে থরে কিছু সাজান আছে । জায়গাটায় আলো বড়ই কম । গোটা চারেক টেবিল ল্যাম্পের মত আলোয় ডেস্কের ওপরটা আলোকিত হয়ে আছে কিন্তু পেছনে যিনি বসে আছেন তার মুখ দেখা যাচ্ছে না ।

– কি চাই ?

আমাকে প্রশ্ন করে কাউন্টারের ওপাশের লোকটা উঠে দাঁড়াল । ধুতি পাঞ্জাবি পরা স্বাভাবিক বাঙালির চেয়ে লম্বা লোকটার ভাঙাচোরা মুখে দেখার মত হল চোখ দুটো । শুধু যে জ্বল জ্বল করছে তাই নয় একটা তীব্র দৃষ্টি যেন মনের ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে । ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে গা ছম ছম করতে লাগল ।

– আজ্ঞে এখানে আবির পাওয়া যাবে ? বোকার মত জিজ্ঞাসা করলাম

– না । বাইরে ফেস্টুন দেখেন নি ? এখানে শুধু রঙ পাওয়া যাবে । তবে সবই আমার নিজের বানানো । এ রঙ আর কোথাও পাবেন না ।

‘আমার আবির দরকার’ বলে ফিরে আসব ভাবছি কিন্তু কৌতূহল পা আটকে দিল ।

– দামী কিছু আছে ? কত করে ভরি ? দামী রঙ যে ভরিতে বিক্রি হয় তা জানা ছিল ।

– দামের কথা পরে , আগে দেখুন পছন্দ হয় কিনা । এবার ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়ে র্যা ক থেকে একটা বাটি বের করে ওপরে রাখলেন ।

– এটার নাম দিয়েছি আনন্দ । তাকিয়ে দেখি বাটির ভেতরে খুব হালকা সাদা রঙের গুড়ো । এতো গুললে রংই হবে না !

– একটু গাঢ় রঙ নেই ? একটা হালকা হাসি খেলে গেল ভাঙাচোরা মুখে

– এটা নিতে পারেন । এটার নাম স্বার্থপরতা । বেশ ঘন রঙ । ধরুন বাপি , যে সব কাজে বুক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে , পরোপকারের ঠ্যালায় বিয়েটা পর্যন্ত করে উঠলে পারে নি , তাকে এটা লাগিয়ে দিলেন । জীবনটা বদলে গিয়ে ওর একটা হিল্লে হয়ে যাবে । তবে জল মেশাবেন না । খাঁটি রঙ হাতে করে লাগিয়ে দেবেন গালে , মাথায় বুকে ।

মনে মনে বললাম আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে ! তবে দুটো জিনিস অবাক করল । প্রথমত: পাড়ার বাপিকে উনি চিনলেন কি করে ? আর দ্বিতীয়ত: রংগুলো । আর পাঁচটা সাধারণ রঙের মত নয় । নামের মতই দেখতেও বিশেষ ধরণের । সব কটা থেকেই হালকা দ্যুতি বেরোচ্ছে । অনেকটা স্ফটিক বা হিরে থেকে যেরকম বেরোয় সেরকম ।

– ষড় রিপুর রঙ গুলো বড্ড চড়া । ধরুন কাম , লাগালে আর রক্ষে নেই । হাজার ঘষলেও আর উঠবে না । আমি তাই পরীক্ষাগারে পদ্ধতিতে অদল বদল করে কামনা আবিষ্কার করেছি । খুব অল্প সময়ের জন্য গায়ে থাকবে । দোলের দিন একটু কামনার ভাব না থাকলে ভাল লাগে বলুন ?

লোকটা বিড় বিড় করছিল । আমি বুঝতে পারছি যে টুপি পড়াচ্ছে , তবু কি যেন একটা কারণে অবিশ্বাসও করতে পারছি না । লোকটা একটা একটা করে রঙ বার করে টেবিলে রাখল

– এই নিন , সহানুভূতি , পরশ্রীকাতরতা , লুব্ধতা , স্তাবকতা , শুদ্ধতা , নিয়মানুবর্তিতা – অনেক ধরণের রঙ আছে । যা খুশি নিয়ে যান

– কিন্তু নেব কি করে ? প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে নিয়ে যাওয়া যাবে ?

– না । আমি সব ব্যবস্থা করে দেব । আমার কাছে বিশেষ পাত্র আছে । আপনি সেগুলোতে করে নিয়ে যান । একটা সিঁদুর কৌটোর মত হালকা চিত্র বিচিত্র রঙ করা পাত্র এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক । হাতে নিয়ে মনে হল কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি । আমি অনেকক্ষণ এসেছি । এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে । ভাবলাম একবার ট্রাই করে দেখতে ক্ষতি কি ?

– ঠিক আছে , আপনি অমুক অমুক রঙ গুলো দিয়ে দিন ।

কেনার সময় খুব অস্বস্তি হচ্ছিল । তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রঙ নির্বাচনের ধরণ দেখে উনি আমার অন্তঃস্থলের কথা পড়ে নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছিল । মুখে একটা হালকা হাসি লেগে আছে । আমি বোধহয় ওনার প্রথম খদ্দের ।

– কত হল ? উত্তরে উনি যা বললেন তাতে অস্বস্তি আরও বাড়ল

– এখন কিছু দিতে হবে না । এটা আমার এক্সপেরিমেন্ট । যদি সফল হয়েছি বলে মনে হয় তাহলে ফিরে আসবেন । তখন দামের কথা হবে ।
– তা কি করে হয় ? বিনা পয়সায় এত রঙ আমি নিয়ে যাব কি করে ? আপনি দয়া করে দামটা বলুন ।

– আপনি ভদ্রলোক , আর আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না ! দেবেন না হয় ধীরে সুস্থে ।

– আপনার নামটা জানা হয় নি । আমি……………হাতটা বাড়িয়ে দিলাম

– মনোজ । একটা স্বাভাবিকের চেয়ে উষ্ণ হাত আমার হাত ছুঁলো । দীক্ষা নেওয়ার পর পদবী বর্জন করেছি ।

নামটাও মানানসই মনোজ – মনে যা জন্মায় । নিজের অজান্তেই আবার কখন এসে গলির মুখে দাঁড়িয়েছি খেয়াল করি নি । বাইরের তীব্র আলোয় সম্বিত ফিরে পেলাম । ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে এ রঙ আমি কাউকে দেব না । বাড়ির সবার জন্য বাজার চলতি রঙ কিনে ফিরলাম ।

আজ মনের মত করে দোল খেলেছি । গোপন রঙে ইচ্ছেমত রাঙিয়েছি সবাইকে । জানতাম এফেক্ট কিছু হবে না তবু ভয়ে আর উত্তেজনায় ফলের জন্য অপেক্ষা করতে পারি নি । বাড়ি ঢুকতেই মেয়ে জিজ্ঞেস করল

– এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে বাবা । ওর চোখের দিকে তাকানোর সাহস ছিল না । অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম

– রোদটা বড্ড চড়া । আর ভালো লাগছে না । এবার স্নান করে ফ্রেস হয়ে নি ।

মেয়ে শ্যাম্পু সাবান দিয়ে গেল । এগুলো দোলের জন্য কেনা । জামা খুলে আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠলাম । বুকে মুখে মাথায় এগুলো কি ? ফসফরাসের মত কি জ্বলছে এসব ? হা ভগবান ! এ তো আমারই রঙ ! হাত থেকে কখন অজান্তে লেগে গেছে । আয়নায় নিজের অন্তরাত্মাকে যেন দেখতে পাচ্ছি । হতাশায় হাঁটু গেড়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লাম । ঠিক তখনই কে যেন কানে কানে বলে গেল

– আমি তো বলেছি , এ রঙ থাকবেনা বেশিক্ষণ । ধুলেই উঠে যাবে । আয়নায় মুখ দেখব না বলে চোখ বুজে আন্দাজে প্রাণপণে শ্যাম্পুর শিশিটা খুঁজতে থাকলাম আমি ………

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here