নীড় ছোট ক্ষতি নেয়, আকাশ তো বড় ~ এই মন বলাকা মোর, অজানার আহ্বানে…..
অথবা
এই পথ যদি না শেষ হয়
…. তবে কেমন হতো তুমি বলতো,
…. যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়
…. তবে কেমন হতো তুমি বলতো..
মহানায়ক উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের এইরকম বহু কালজয়ী গানের মূল প্রাণদাতা। মায়াবি সেই হাসির নায়ক, সদা রোমান্টিক আর কিংবদন্তী অভিনয় জাদুকর এই উত্তম কুমার-কে বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে ‘মহানায়ক’ আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তার জাদুস্পর্শে অনেক সাধারণ গল্প-স্ক্রিপ্ট প্রাণ পেয়ে যেত খুব সহজেই। তিনি একাধারে ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা, চিত্রপ্রযোজক ও পরিচালক। ইতিহাসের অমোঘ বিস্ময়কর এই অভিনেতা চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়াও তিনি সফলভাবে মঞ্চেও অভিনয় করেছিলেন।
উত্তম কুমার ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার আহিরীটোলায় জন্মগ্রহণ করেন। সকলেই জানি তাঁর আসল নাম অরুন কুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি ১৯৩৫ সালে নাটকের দল ‘লুনার ক্লাব’ গঠন করেন এবং ১৯৩৬ সালে চক্রবেড়িয়া স্কুলে পড়ার সময় ‘গয়াসুর’ নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা ও পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
১৯৪২ সালে কলকাতার সাউথ সাবারবান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং পরে গোয়েঙ্কা কলেজে ভর্তি হন। কলকাতার পোর্টে চাকরি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও তিনি তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি। সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে তাকেও অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
উত্তম কুমারের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ছিল দৃষ্টিদান। ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সেই বছরেই তিনি গৌরী দেবীকে বিয়ে করেন।
প্রথম নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৪৯-এ ‘কামনা’ ছবিতে উত্তম চট্টোপাধ্যায় নামে। আর উত্তম কুমার নামে অভিনয় শুরু করেন ১৯৫১ তে ‘সহযাত্রী’ তে। ঠিক সেই বছরই ছেলে গৌতমের জন্ম হয়।
তার প্রথম হিট ছবি মুক্তি পায় ১৯৫২ সালে “বসু পরিবার” নামে। চাকরি ছেড়ে তখন পুরোপুরি অভিনয়ে নেমে পরেন।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয় ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে-চুয়াত্তর’ মুক্তি পাওয়ার মধ্য দিয়ে…
১৯৫৪ এ জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙে দিল উত্তম-সুচিত্রার ‘অগ্নিপরীক্ষা’।
১৯৫৬ সালে ‘নবজন্ম’ ছবিতে নিজের কন্ঠে প্রথম গান গাইলেন। ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত ‘হারানো সুর’ ছবিতে অভিনয় করে সমগ্র ভারতজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। সেই বছর ‘হারানো সুর’ পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অফ মেরিট।
তারপর ১৯৫৭ তে বাংলা ভাষার প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন ছবি ‘পথে হলো দেরী’-তে অভিনয় করে আরেক রেকর্ডের কীর্তি তৈরি করেন। উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অনেকগুলি ব্যবসায়িক সফল এবং প্রশংসিত চলচ্চিত্রে মুখ্য ভূমিকায় যুগলে অভিনয় করেছিলেন। এগুলির মধ্যে প্রধান হল – হারানো সুর, পথে হল দেরী, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, জীবন তৃষ্ণা এবং সাগরিকা।
উত্তম কুমার বহু সফল বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। তাঁর অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটিসি মুলাকাত, অমানুষ এবং আনন্দ আশ্রম অন্যতম।
রোমান্টিক নায়ক ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রেও তিনি ছিলেন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটি নায়ক এবং দ্বিতীয়টি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানা চলচ্চিত্রে তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
১৯৬৭ সালে ‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন (তখন এই পুরস্কারের নাম ছিল ‘ভরত’)।
এছাড়া তিনি নিউইয়র্ক, বার্লিন চলচ্চিত্র প্রভৃতি সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসবের অতিথির সম্মানও অর্জন করেছিলেন।
উত্তম কুমার পরিচালক হিসেবেও সফল। কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১), বনপলাশীর পদাবলী (১৯৭৩) ও শুধু একটি বছর (১৯৬৬) ছবির সাফল্য তাই প্রমাণ করে।
ভুবনভোলানো হাসির মহানায়ক আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নেন আজকের দিনে ২৪ জুলাই ১৯৮০, রাত ৯টা ৩০ মিনিটে, বেলভিউ ক্লিনিকে। তার অনবদ্য অভিনয় দেখলে কখনও মনে হয় না যে তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। এখনও মনে হয় তিনি আজও তার স্বভাব সুলভ কায়দায় হাঁটছেন, গাইছেন আমাদের সামনে। মাত্র ৫৪ বছরের ক্ষণজন্মা কিংবদন্তী এই মহানায়ক অভিনয় জীবনের মাত্র ৩২ বছরে আমাদের যা দিয়ে গেছেন তা থাকবে যুগ থেকে যুগান্তর পর্যন্ত। মহানায়ক আজকের দিনে তোমায় জানাই সেলাম।