ওয়েব ডেস্কঃ পঞ্চমদা বলেই বাঙালি তথা বিশ্বের কাছে বেশি পরিচিত। এই পঞ্চমদা নামের পেছনে আছে একটি ছোটগল্প। ছোটবেলায় যখন কাঁদতেন তখন নাকি তার কান্নার আওয়াজ নাসিকা গোড়া থেকে অনেকটা ‘সারেগামাপাসা’র ‘পা’র মতো শোনা যেত। স্বরলিপির পঞ্চম সুরে কান্নার জন্যই তাকে ডাকা হতো পঞ্চম নামে। সংগীতপ্রেমী পরিবারে তিনিও ছিলেন মজার রসিকতায়। আর এই রসিকতার রেশ ধরেই তার নামও হয়ে যায় পঞ্চমদা। স্বাভাবিক ভাবেই কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শচীন দেবের সন্তানের কান্নার আওয়াজ তো ‘পা’র মতো শোনাতেই পারে। কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী রাহুল দেব বর্মণের আদুরে নামের গল্প এইরকমই।
রাহুল দেব বর্মণ (জন্ম : ২৭ জুন ১৯৩৯, মৃত্যু : ৪ জানুয়ারি ১৯৯৪)
কলকাতার ত্রিপুরার রাজপরিবারে জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালে ২৭ জুন। আর. ডি. বর্মণের বাবা কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা শচীন দেব বর্মণ জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে। তবে পঞ্চম কখনও পিতৃভিটায় যাননি। বাবার পথ ধরেই সুরের ঝরণায় গা ভাসিয়েছেন ছেলে। সংগীত পরিবেশে বেড়ে ওঠা রাহুল একসময় হয়ে ওঠেন ভারতের জনপ্রিয় গায়ক এবং সুরকার। ওই যুগে শুধু আর. ডি. বর্মণের গান ও সুর ব্যবহারের জন্য অনেকেই ছবি বানাতেন! তার করা গান আর সুরের নতুন নতুন সংস্করণ আজও বিভিন্ন সিনেমায় ব্যবহার করা হয়। তিনিই প্রথম ভারতীয় সংগীত জগতকে পরিচয় করিয়েছিলেন ইলেকট্রিক গিটার, রক অ্যান্ড রোলের সংমিশ্রণ। এভাবেই তিনি জাদু দেখিয়েছিলেন ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবির ‘আজা আজা ম্যায় হু পেয়ার তেরা’ গানে। এ ছাড়াও আর. ডি. ই প্রথম বলিউডে ব্লুজ ও লাতিন আমেরিকান সংগীতের প্রবর্তন করেন।
হিন্দি গানের জন্য সুনাম কুড়ালেও সবার প্রিয় পঞ্চমদা আগাগোড়াই ছিলেন একজন বাঙালি। ৩৩ বছরের পেশাদার জীবনে তিনি ৩৩১টি ছবির সংগীত পরিচালনা করেন। তার মধ্যে ছিল ২৯২টি হিন্দি, ৩১টি বাংলা, ৩টি তেলেগু, ২টি করে তামিল ও ওড়িয়া এবং ১টি মারাঠি ছবি। ১৯৬১ সালে তিনি প্রথম কাজ করেন অভিনেতা মেহমুদ প্রযোজিত ‘ছোট নবাব’ ছবিতে। অন্যান্য ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শোলে’, ‘গোলমাল’, ‘সনম তেরি কসম’, ‘মাসুম’, ‘ইয়াদো কি বারাত’, ‘খুবসুরত’, ‘১৯৪২ এ লাভ স্টোরি’, ‘ক্যারাভান’, ‘আপ কি কসম’, ‘খেল খেল মে’, ‘মেহবুবা’, ‘হাম কিসিসে কাম নাহি’, ‘কিনারা’, ‘শালিমার’, ‘শান’, ‘বেতাব’, ‘সাগর’ প্রভৃতি। তবু শেষের ‘১৯৪২ এ লাভ স্টোরি’ ছবিটি মুক্তির আগেই তিনি মারা যান।
এছাড়াও ‘বাচনা এ হাসিনো’, ‘মনিকা ও মাই ডার্লিং’, ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’, ‘মেরে ন্যায়না সাওন ভাদো’, ‘চিঙ্গারি কোই ভাড়কে’, ‘দম মারো দম’, ‘চুরালিয়া হ্যায় তুমনে জো দিল কো’, ‘পিয়া আব তু আজা’, ‘যাহা তেরি ইয়ে নজর হ্যায়’, ‘চালা জাতা হু কিসিকি ধুন মে’, ‘তু তু হ্যায় ওহি’, ‘মেহবুবা মেহবুবা’, ‘ইয়ে দোস্তি’, ‘আজা মেরি জান কাহা থা তুনে সনম’, ‘এক লাড়কি কো দেখা তো’; এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা আর.ডি. বর্মণ। এসব গান আজও রিমেক করা হয়। এছাড়া ছবির দৃশ্য অনুযায়ী আবহসংগীতেও জমিয়ে তাল মেলাতেন তিনি। সেরা সংগীত পরিচালক হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসে তিনবার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আর অসংখ্যবার মনোনীত হয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে রাহুল দেব বর্মণ ১৯৬৬ সালে প্রথম বিয়ে করেন রিতা প্যাটেলকে। দার্জিলিংয়ে পরিচয় হয়েছিল তাদের। রিতা ছিলেন পঞ্চমের অন্ধভক্ত। পাঁচ বছরের মাথায় তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এরপর ‘পরিচয়’ (১৯৭২) ছবির ‘মুসাফির হু ইয়ারো’ গানটি হোটেলে বসে সুর করেছিলেন আর. ডি. বর্মণ। ১৯৮০ সালে তিনি বিয়ে করেন প্রখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলেকে। এই সংগীত দম্পতি একসঙ্গে অনেক কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের।
রাহুল দেব বর্মনের কালজয়ী কিছু বাংলা গান – ও আমার ময়নাগো, মনে পড়ে রুবী রায়, যেতে যেতে পথে হল দেরি, তুমি কতো যে দূরে, রূপসী বলনা কে বেশি, রিমঝিম বৃষ্টি, অঝোর ধারা, যেতে পার, যাবেই যদি গো চলে, কি হবে আর পুরনো দিনের কথা, চোখে নামে বৃষ্টি, কোথা কোথা খুঁজেছি তোমায়, একটি কথা হায় সে তো, ফিরে এলাম দূরে গিয়ে, ভেবেছি ভুলে যাব, পারিনা তো ভুলিতে, প্রেম কিসে হয় তা কেউ কি জানে, আজি দোলে মন কার ইশারায়।
জীবন সায়াহ্নে এসে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়েছিলেন পঞ্চমদা। ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি মারা যান তিনি। আর. ডি. বর্মণকে মনে করা হতো হিন্দি ছবির সংগীতাঙ্গনের ভগবান। কিংবদন্তি এই শিল্পীর সুরের জাদু তার মৃত্যুর দুই দশকের বেশী সময় ধরে সমানভাবে নাড়া দেয় শ্রোতাদের। রাহুল দেব বর্মণের প্রতি খবর২৪-এর পক্ষ থেকে রইলো শ্রদ্ধার্ঘ্য।