পথ —– ২৭
—————–
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ চোখের সামনে আলমারিতে সাজানো কত কত বই। প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়ছি।
নতুন নতুন কাহিনীর স্বাদ নিচ্ছি। কিন্তু এই আমি বই পড়ে পূর্ণাঙ্গ কাহিনীর
স্বাদ নেওয়ার অনেক আগে দেখি যাত্রা। এই যাত্রায় দেখা কাহিনীই আমার জীবনে
পাওয়া প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাহিনীর স্বাদ।
রথ উপলক্ষে ধনেখালি বারোয়ারীতলায় সাত দিন ধরে যাত্রা হতো। আজও সেই নিয়মের
অন্যথা হয় নি। আমরা সন্ধ্যেবেলা যখন ভোগ খেয়ে বাড়ি ফিরতাম তখনই খবর নিয়ে
আসতাম যাত্রার নাম, কোথাকার দল, কোনো বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রী আসছে কিনা।
বাড়ি ফিরেই সারা পাড়ায় সেই সমস্ত খবর রাষ্ট্র করে দিতাম।
কলকাতা চিৎপুর যাত্রা পাড়ার অনেক বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীরা আমাদের
ধনেখালি বারোয়ারীতলার যাত্রামঞ্চে অভিনয় করে গেছেন। জ্যোৎস্না দত্ত, গুরুদাস
বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ দাসগুপ্ত, খোকন ব্যানার্জীকে আমরা আমাদের কৈশোর থেকেই
দেখে আসছি।
যাত্রা দেখা মানেই রাত জাগা। আর রাত জাগা মানেই শরীরের কষ্ট। তাই মা
কিছুতেই আসতে দিত না। দিদি তো আরও এককাঠি বাড়া। অথচ এই মা-ই রাত জেগে
পড়াশোনায় কোনো বাধা দিত না।
আটটা বেজে গেলেই মা আমাকে শুয়ে পড়ার জন্য ডাকতো। বলতো —– আগে একটু
ঘুমিয়ে নে। তা না হলে যাত্রা দেখতে দেখতে ঘুমে ঢুলবি।
এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। না শুলে দিদি মারতো। বেশিরভাগ দিনই ঘুম
ভাঙত না। একঘুমেই সকাল। মা মিথ্যে করে বলতো —– তোকে কতবার ডাকলাম। তুই
উঠলিই না।
তর্ক করতে পারতাম না। ঘুমের ঘোরে কি করেছি তা কি আর সকালে মনে আছে। এক
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যাত্রা দেখতে না পাওয়ার কষ্টে রেগে গিয়ে খুব
কাঁদতাম।
মা যেদিন যাত্রা দেখতে যেত সেদিন আমার যাওয়া নিশ্চিত। দিদিও অবশ্য মাঝে
মাঝে আমাকে নিয়ে যেত।জেগে থেকে সমস্ত যাত্রাটা দেখা কোনোদিনই প্রায় হয়ে ওঠে
নি। কিছুটা দেখেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে মনে হতো আমার গালে কে
যেন ফোঁটা ফোঁটা জল ফেলছে। চোখ খুলে দেখতাম মা কাঁদছে।
হরিৎ: 28/06/2017
********************