Home ব্লগবাজি পথ —– ৩৭

পথ —– ৩৭

পথ —– ৩৭

পথ —– ৩৭

——————
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
 
     দুর্গা ঠাকুরের চোখ আঁকত সুরেশ পাল নিজে। খুব কম কথা বলতো। চোখ আঁকার সময় দেখতাম তার চোখ মুখের চেহারা যেত বদলে। এসব দেখতাম বাইরে থেকে। ভেতরে ঢোকার সাহস হতো না। সদর দরজার ঢোকার মুখে যেমন ভিখারিরা দাঁড়িয়ে থাকে আমিও তেমনি স্টুডিওর মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাম। একটু একটু করে এগিয়ে যেতাম। পরের দিন যখন আবার আসতাম তখন আগের দিন যেখান থেকে শেষ করেছিলাম সেইখানে গিয়ে দাঁড়াতাম। এইভাবেই একদিন পুরোপুরি ঢুকে পড়লাম।
     হাতের কাছে রঙ এনে দিতাম। তেষ্টার জল এনে দিতাম কল থেকে। আস্তে আস্তে ওদের একজন হয়ে গেলাম। এটা আমার একটা বিরাট প্রাপ্তি। আমার আর কিছুর প্রয়োজন ছিল না। ভেতরে ঢুকে মনে হতো আমি যেন কতো দামি হয়ে গেছি। বাইরে থেকে যখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হতো না তখন আমি ভেতরে। যেন মনে হতো আমি অনেক ক্ষমতার অধিকারী।
     শিল্পীদের পাশে পাশে ঘুরে বেড়াতাম। সুরেশ পাল ছাড়াও আরও একজন চোখ আঁকত। সে হল নবাদা। আস্তে আস্তে সুরেশ পাল চোখ আঁকা ছেড়ে দেয়। নবাদার ওপরেই সব দায়িত্ব গিয়ে পড়ে। যারা চোখ আঁকত তারা আমার কাছে ছিল সবচেয়ে মূল্যবান শিল্পী। তাদের শ্রদ্ধা করতাম, ভালোবাসতাম। তাই নবাদা যখন কোনো কাজ বলত আমি সাথে সাথে তা করে দিতাম।
     চোখ আঁকার সময় স্টুডিওর ভেতরটা একেবারে চুপচাপ থাকত। এই নির্জনতা আমাকে খুব টানত। মুখে বলতে না পারলেও মনে মনে খুব চাইতাম এইখানেই যেন আমার সারাদিনটা কেটে যায়। আমার খেলাধূলা তখন সব বন্ধ। এমনকি পড়াশোনাও করতে ভালো লাগত না।
     বারোয়ারির ঠাকুরটা এখানেই একটা বিশেষ জায়গায় রাখা থাকত। মনে হতো এটা আমাদের ঠাকুর। চোখ আঁকা, কাপড় পরানো হয়ে গেলে মনে হতো পুজো আর বেশি দূরে নেই। তারপরেই একদিন দেখতাম ঢাকির দল চলে এল। মূর্তিগুলোকে এত কাছের থেকে রোজ একটু একটু করে বদলে যেতে দেখতাম যে তারা যখন মণ্ডপে এসে ঠাকুর রূপে বসত তখন তাদের ঠাকুর রূপে মানতে পারতাম না। মনে হতো আমাদের ঘরেরই একজন কেউ।
     ক্রেতারা কিনতে আসার আগে ঠাকুরগুলো সুন্দর করে সাজানো থাকত। আমি তাদের ঘুরে ঘুরে দেখতাম। মনে হতো চোখের সামনে আমি যেন কোনো নারীকে দেখছি। এককথায় তাদের ভীষণভাবে মানুষ বলে মনে হতো। এইকারণের জন্যই একদিন একটা মূর্তিকে ছুঁয়ে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখছি। সুরেশ পাল দেখতে পেয়ে যায়। আমাকে ডেকে খুব বকেছিল। তারপর থেকে ওখানে আমার ঢোকার অধিকার চলে যায়। ওদেরকে আমি বোঝাতে পারি নি আমার উদ্দেশ্য। ওই বয়সে সেটা সম্ভবও নয়। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তবে এটাও ঠিক আমার যে একটা চোখ তৈরি হচ্ছে সেটাও বুঝতে পেরেছিলাম। এটা আমার জীবনে একটা বড় প্রাপ্তি।
                           *****************

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here