Home ব্লগবাজি পথ —– ৬ ~ হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

পথ —– ৬ ~ হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

পথ —– ৬   ~    হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
পথ ----- ৬
*****************
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়




     এখন সারাদিন যত পরিশ্রমই করি না কেন রাত দেড়টা দুটোর আগে কিছুতেই ঘুমাতে
ইচ্ছে করে না। এই যে রাতকে ভালোবাসতে শেখা এর জন্য দায়ী আমার বাবা মা উভয়েই।
     আমাদের বাড়ির অবস্থানটা এমনই ছিল যে সেখানে বাড়ির নিজস্বতা বলতে কিছু
ছিল না। বাড়ির মাঝখান দিয়ে রাস্তা। সাইকেল, এমনকি মোটরসাইকেল পর্যন্ত বিনা
বাধায় চলে যেত। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যে কেউ আমাদের বাড়ির দুয়ারে
কিছুক্ষণ কাটিয়ে যেত। তাই লক্ষ্য করলে দেখা যেত বাড়ির দুয়ারে সবসময় কেউ না
কেউ একজন বসে আছেই। ছাত্রাবস্থায় দিনের বেলা পড়াশোনা করাই আমার পক্ষে সমস্যা
হয়ে যেত। কিন্তু তবুও পড়তে হতো। এই সমস্যার মধ্যে থাকতে থাকতেই একটা সমাধানের
পথ বেরিয়ে আসে। যেহেতু গ্রামঘর তাই দশটার মধ্যেই চারপাশ চুপচাপ হয়ে যেত।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত তখন আমাদের অভিযান শুরু হতো।
     আমার ছোটবেলায় মা বলত, "বোকারাই রাতের বেশিরভাগটা ঘুমিয়ে কাটায়। ভালো
করে চেয়ে দেখ, রাতটা কত সুন্দর। দিনের সাথে তার কোনো তুলনাই চলে না।" এই
কথাগুলো রক্তের মধ্যে এমনভাবে ঢুকে পরেছিল যে, আজও তার প্রভাব পুরোমাত্রায়
বিদ্যমান।
     এমন কত দিন হয়েছে, রাত একটায় পড়াশোনা করে শুয়েছি। মা আবার চারটেয় তুলে
দিয়েছে। আমাদের ঘড়ি ছিল না। মা ভোরের শুকতারা দেখে আবার আমাকে তুলে দিত। মাঝে
চারঘন্টাও ঘুম হতো না। এর জন্য মায়ের বিন্দুমাত্রও ভাবনা ছিল না। বরং মুখে
বলত, "সবাই কেমন পড়ছে আর আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে। মানুষ তোকে হতে হবে না, তুই গরু
হবি।" সবাই পড়ছে বলতে আমার কাকা জ্যেঠার ছেলেমেয়েরা। তারা পড়বে না কেন? তারা
তো রাত এগারোটায় রোজ ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আমি যে রাত একটা পর্যন্ত পড়েছি তার
বেলা? কিন্তু মাকে বোঝাবে কে? এক একদিন সাড়া না দিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকতাম।
কিন্তু তাতে লাভ হতো না। কানের কাছে এককথা একশবার আউড়ে যেত। ঘুম তো হতোই না,
তার ওপর একনাগাড়ে বকে চলার জন্য চুপচাপ শুয়ে থাকাও যেত না। তার থেকে উঠে
পড়ে পড়তে বসা অনেক বেশি শান্তির। আজ বুঝতে পারি, মা কতখানি ভালো করেছে।
নিজের বিদ্যে বলতে ক্লাস ফোর। কিন্তু নিজে পড়াশোনার মূল্য কতখানি বুঝতে
পেরেছিল তাই তো আমার অস্তিত্বের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে পেরেছিল -----
শুধুমাত্র চাকরির জন্য নয়, পড়াশোনাটাকে ভালোবাসতে হবে।
     একটা ঘটনা না বলে পারছি না। আজকের প্রজন্মের কাছে যদিও এটা শুধুমাত্র
পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের ঘড়ি ছিল না। তাই কত রাত পর্যন্ত পড়তাম
জানতেও পারতাম না। এক একদিন এমনও হয়েছে, শোওয়ার সাথে সাথে মনে হতো মা যেন
আবার ডাকছে। বুঝতে পারতাম রাতে একটু বেশি সময় পর্যন্ত পড়া হয়ে গেছে। মা এক
একদিন মেজ জ্যেঠিমাদের বাড়ি থেকে একটা টেবিল ঘড়ি চেয়ে নিয়ে আসত। সেদিন আমার
আনন্দ দেখে কে! রাতকে নিজের রূপে আজ দেখতে পাবো। ঘড়িটাকে সামনে রেখে আমি
রাতকে পড়তাম। আমাদের তো আর বারান্দা ছিল না। তাই দরজা খুলে মাঝে মাঝেই
বেরিয়ে আসতাম। অত রাতে কী দেখবো? চারপাশের নৈঃশব্দ্যকে অনুভব করার চেষ্টা
করতাম। আর দেখতাম পথকে। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একটু পা ছড়িয়ে
শুয়েছে। কেউ কোথাও নেই। তার একাকিত্ব আমাকে ছুঁয়ে যেত।
                                                 হরিৎ:25/05/2017

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here