বিষক্ষয় : সুদাস ভট্টাচার্য্য

বিষক্ষয় : সুদাস ভট্টাচার্য্য

সমুদ্রমন্থনে অমৃতের সঙ্গে বিষও উঠে এসেছিল । দেবতারা প্রত্যেকবারের মত ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের পায়ে হত্যে দিয়ে পড়লেন । টিপিকাল ধান্দাবাজ । যখন অমৃত পান করেছিলি তখন কি বলেছিলি যে আপনারা তিনজন খান , তাতেই হবে ? নেশাখোর শিব ভাবলেন গাঁজা ভাঙ খেয়ে আমার আজকাল আর নেশা হচ্ছে না । সামান্য হলাহলে আর কি হবে ! সে সময়ে মহাদেব নেশাগ্রস্ত ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য কিছুই পাওয়া যায় নি । তিনি ওই হাই প্রোটিন ঢকঢক করে পুরোটা মেরে দিলেন । এখানে অলৌকিক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল , কিন্তু হল না । শিব কেতরে পড়লেন ।

আমি পৌরাণিক কাহিনী শোনাতে বসি নি । শুধু বলে রাখা যে ওরকম দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেবতার পক্ষেও বিষ হজম করা সম্ভব হয় নি । এবারে বর্তমানে ফিরি । আজকাল আমরা মিডিয়া নামক ব্রহ্মজ্ঞানীর সন্ধান পেয়েছি । স্বাভাবিক ভাবেই সবকিছুই আমাদের জানা । সকালে উঠে দুধ আনতে যাওয়ার সময় মনে হল কাল রাতে টিভিতে দেখেছি ইউরিয়া দিয়ে কি একটা উপায়ে কৃত্রিম দুধ তৈরি করে কিছু অসাধু লোক বাজারে বেচছে । এখনও যখন মরি নি তখন সামান্য ইউরিয়া আমার কিস্যু করতে পারবে না – এরকম একটা ধারণা নিয়েই বেড়িয়েছিলাম । ফেরার পথে দুশ্চিন্তা হল । মা রোজ সকালে একটা বাটিতে নিমপাতা আর কারিপাতা রেখে দেয় । ওটা খালি পেটে আমাকে খেতে হয় । এতে নাকি ত্বক ভাল থাকে । ধাপার ফুলকপি সবাই দেখেছেন । পেয়ারা , টমাটো বীজ শুদ্ধ খাই । ভয় হল ভাল সার পেয়ে গাছ না গজিয়ে যায় !

কলকাতা থেকে খাটাল উচ্ছেদের ফলে খাঁটি ( কর্পোরেশনের জল সহ) গরু বা মোষের দুধ আর পাওয়া যায় না । তবে ভেজাল খেতে খেতে খাঁটি দুধ সহ্য হবে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে । দেখা নয় শোনা কথা , শহরতলীর এক খাটালের বাইরে নাকি বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে “ এখানে বিশুদ্ধ মহিষের দুধ পাওয়া যায় । আধসের পান করিবার পর রক্ত আমাশয় না হইলে মূল্য ফিরত ” । আশার কথা যত দিন যাচ্ছে বাঙালি ততই দুগ্ধপোষ্য থেকে বোতলপোষ্য হয়ে উঠছে । তাই বিশেষ ক্ষতি হয়তো হবে না ।

দুধ এনে এককাপ চা আর দুটো থিন অ্যারারুট বিস্কুট পেঁদিয়ে বাজার করতে যাই । মাছটা আগে কিনলেই সুবিধে । কি মাছ কিনব ? অন্ধ্রের বিশাল সাইজের রুই কাতলা বডি ফেলে দিয়েছে । এতে নাকি পচন না ধরার ওষুধ ইঞ্জেক্ট করা আছে । পবদা কাজরীর রঙ দুধে আলতা । চিংড়ি বিদেশে রফতানি করা যাচ্ছে না বলে দাম কম । বাটা বা চারাপোনা কাঁটা বেশি বলে বাড়িতে ছোটরা খায় না । হাইব্রিড মাগুর নামের একটা মাছ বাজারে এসেছে । সেজদা একদিন আনমনে ট্যাক্সের রিটার্ন ভরার কথা চিন্তা করতে করতে ভুল করে ‘ কত করে রে ? ’ বলে হাত দিয়ে ফেলেছিল । বেচারা রোজ এ দপ্তর থেকে ও দপ্তর ছুটে বেড়াচ্ছে । বুড়ো আঙুলের কিছুটা মাছের পেটে চলে যাওয়ায় থাম ইম্প্রেশনে হাজিরা দিতে পারছে না ।

যা থাকে কপালে বলে জ্যান্ত কাতলার হাফ আর কটা জ্যান্ত ট্যাংরা কিনে সবজি বাজারের দিকে পা বাড়ালাম । একদম সামনে এঁচোড় নিয়ে এক মাসি বসে আছে । এই ফাল্গুনের শুরুতেই এঁচোড় নধর হল কি করে ? শালারা বোধহয় জন্ম থেকেই এঁচোড়ে পাকা । পাশেই ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে । ভেজাল নয়, ধাপার মাল বলেই মনে হল । কেটে সেদ্ধ করে জল না ফেলে একবার কেউ খেয়ে দেখুন । এমন গ্যাস হবে সারাদিন সিলিং এ আটকে থাকতে হবে । বসন্ত আগমনে চিকেন পক্সের ভয়ে সজনে ডাঁটা দিয়ে শুক্তো, সজনে ফুল , নিমপাতা ভাজা- এ সব খেতে হয় বলে বাবা কাকাদের কাছে শুনেছি । শুক্তো ছাড়া বাকি কিছু ছেলে মেয়ে মুখেই তুলবে না । রাঙা আলু ছাড়া শুক্তো হয় না । কিনব বলে হাত দিতেই অকাল হোলী । এমন গোলাপি রঙ লেগে গেল যে ধুলেও উঠল না । পটল দু প্রকার , নতুন ফুল লাগা হালকা সবুজ রঙের গুলো ১৫০ টাকা কেজি । আর চকচকে সবুজ গুলো একটু কমদামী । ওখানেই গ্যাঁড়াকল । এক কিলো পটলে ২৫০গ্রাম রঙ ফ্রি । বেগুনের মত বে-গুন সবজিতেও যে রঙ করা থাকে তা এই প্রথম জানলাম । আলুতে আবার মাটির কারিকুরি । ধুয়ে না দিলে গরুও খাবে না । ঝিঙে , উচ্ছে সব দোল খেলে উঠেছে ।

মিডিয়ায় দেখেছি এই রঙ পেটে গেলে ক্যানসার অনিবার্য । না হলে নিদেনপক্ষে পক্ষাঘাত তো অবশ্যম্ভাবী । যতই যত্ন করে খোলা ছাড়িয়ে ভিজিয়ে রেখে খাই না কেন কিছুটা বিষ তো পেটে যাচ্ছেই । এতদিন আশা ছিল আধুনিক চিকিৎসায় ওষুধ বিষুধ খেলে হয়তো বেঁচে যাব । সেদিন খবরে দেখি ডেট পেরিয়ে যাওয়া ওষুধ থেকে ডেট তুলে নাকি আবার নতুন করে ডেট বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে । হিসেবটা সোজা । তুমি যখন এত বিষ খাচ্ছো তখন সাধারণ ওষুধে কোন কাজ হবে না । তাই ওষুধগুলোকে বিষাক্ত করে বেচা হচ্ছে । প্রবাদ আছে বিষে বিষে বিষক্ষয় । কিন্তু এ প্রবাদের স্রষ্টা কে জানি না । পরমেশ্বরী যে পদ্ধতিতে মহাদেবের বিষ টেনে গলার কাছে এনে তাঁকে নীলকণ্ঠ করে দিয়েছিলেন সে পদ্ধতিতে উপশমেরও আশা নেই । ব্রেস্ট ফিডিং এর যুগ শেষ । তা ছাড়া কার বুকের পাটা এত বড় যে বৌ কে ডেকে বলবে

– ও গো আমার বিষ টা একটু ঝেড়ে দাও না ।

অফিস টাইমে বললে বিষদাঁত ঝেড়ে দেবে । তাই যতক্ষণ কেতরে না পড়ছি ততক্ষণ বিষের সঙ্গে সমঝোতা করেই বেঁচে থাকতে হবে ।

তা হলে বাঁচব কি ভরসায় ? দিদার কাছে শুনেছিলাম আমরা অমৃতের পুত্র কন্যা । তাই ভালবাসার বিষ ,বাধ্যতামূলক বিষ , অপারগতার বিষ , অক্ষমতার বিষ – কিছুই আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না । শুধু এই ভরসাতেই বেঁচে আছি………………।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here