মেঘের দেশে চন্দ্রোদয়

মেঘের দেশে চন্দ্রোদয়

পাখীমন রায়
একলা আকাশ ডাকছে আমায় -/ সময় হবে তোর ?/ অনেকদিন যে রাত জেগেছিস -/ দ্যাখা হয়নি ভোর, /অনেকদিন একটানা নাগরিক দৌড়ঝাঁপের পর মন উচাটন। পালাই পালাই মনটা পেল প্রেমিকের চিঠি-

সময় হলে আসিস কাছে/ ইচ্ছে ডানায় ভেসে /তুই ও যাবি আমি ও যাব/ মেঘ-পরীদের দেশে।

পাহাড়ের অন্য সব জায়গা যখন অশান্ত, বাঙালীর পূজার বেড়ানোর জায়গায় টান, তখন হাজির হলাম ছোটমাঙ্গয়া। বড়ামাঙ্গয়া নিয়ে অনেকদিন ধরেই ভ্রমণ সংক্রান্ত অনেক পত্র পত্রিকায় অনেক কিছু পড়েছি। কিন্তু আমাদের গন্তব্য নিয়ে সেরকম কোন খবর আমাদের হাতের কাছে ছিলনা। আমরা একদিন দার্জিলিং ঘুরে পরদিন যাব ঠিক ছিল। নিজেরা যাবার ব্যাবস্থা করার চাইতে প্রধান সাহেবকে ফোন করে যোগাযোগ করে রাখলে উনি গাড়ি পাঠাবেন বা গাড়ির ব্যাবস্থা করে দেবেন। কারন NGP বা শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং এর সাধারন ভাড়া গাড়ি এই ধরনের অল্প চেনা জায়গায় সবসময় যেতে চায় না।

রাস্তা খুব খারাপ। বিশেষত বর্ষার পরে। পথে একবার গাড়ি বদল করতে হল। একটু বিরক্ত হলাম। তবে পরে বুঝলাম এটা local employment generation এরই অঙ্গ। অসুবিধা হবেনা কারন প্রধান সাহেবের নির্দেশ মত ড্রাইভার বা হেল্পাররা মালপত্র নামান ওঠানোতে সাহায্য করবে। ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রামের ভিতর দিয়ে পথ। কখনো চড়াই কখনও উতরাই। ভালোই লাগবে। পথের ঝাঁকানি বা কষ্টের দিকে নজর দিতে হলে এইসব জায়গায় বেড়াতে না আসাই ভালো। যারা সত্যিই প্রকৃতি, নতুন মানুষ, অন্য জীবনযাত্রা দেখতে ভালো বাসেন, তারা এই পথে আসুন।


আমরা সবাই হাল্কা গরম জলে হাতমুখ ধুয়ে বাইরে চেয়ারে বসলাম গরম কফি আর ভেজ পকড়া নিয়ে। আকাশ আর পাহাড়ের কোল জুড়ে মেঘের মেলা, হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া। দুপুরে খাবার পর হেঁটে বেরলাম গ্রাম দেখতে। সামনেই একটি ছোট চার্চ। লেখা আছেMangmaya Pastorate Church. সান্ধ্য আরাধনা চলছিল। একটু দাঁড়ালাম। আরাধনা শেষ হল। একগাদা কচিকাঁচা কলকল করতে করতে বেরিয়ে এল। আমরা ফাদারের অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। চারপাশের প্রকৃতির মতই নিরাভরন সাদামাটা চার্চ। ফাদারের সাথে গল্প করে অনেক কথা জানা গেল। সরকারি কাগজ অনুযায়ী এই জায়গার নাম মাঙ্গয়া। প্রধান সাহেবের brain child হল এই প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র।এক সময় পৌঁছে গেলাম। একটা ছোট পাহাড়ের একেবারে উপর দিয়েই পথ। শুনতে অবাক লাগছে? আমরাও খুব অবাক হয়েছিলাম। এই কারনেই পথটি খুবই সরু। পাশাপাশি দুজন হাঁটা যায়না। অবশ্য এরকম রাস্তা খুবই অল্প। আগে পরে খুব প্রশস্ত না হলেও চওড়া রাস্তা আছে। প্রথমে প্রধান সাহেবের অফিসঘর। তারপর ডাইনিং হল। পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে ছোট একটু ফুলের বাগান। তারপর গা লাগোয়া পরপর তিনটি ঘরের (কটেজ)একটি কমপ্লেক্স। পাহাড়ি পাখির নামে নাম। প্রতিটি সুন্দর সাজান। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা পরিস্কার বাঁধানো, রেলিং দিয়ে ঘেরা। সুন্দর বসার চেয়ার দিয়ে সাজান। সামনে পিছনে যেদিকে চোখ ফেরাবেন সেদিকেই শুধু সবুজ সমুদ্র আর পাহাড়ের ছোট বড় ঢেউ। চারপাশে ফুল আর প্রজাপতির মেলার মাঝে আর একটি রঙিন প্রজাপতির মতই প্রায় উড়তে উড়তে এল চামেলি, প্রধান সাহেবের (পালিতা) কন্যা। মুহূর্তের ভিতর বহু কথা বলে জানিয়ে দিলো যে আমাদের যখন যা লাগবে, খাবারই হোক বা গরম জল, চামেলিকে আওয়াজ দিলেই চলে আসবে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা? ও আর বিশেষ কি! ও তো খাটে শুয়েই দেখা যায়। তাই? একটু ছদ্ম বিস্ময়ে আর মনে অবিশ্বাস নিয়ে আমরা মজা করলাম। বুদ্ধিমতী মেয়েটি বুঝে গেল। দুষ্টুমি করে আঙুল তুলে রেলিং পার করে সামনে দেখাল। ওই তো। আমরা এবার একটু অবাক হয়ে তাকালাম। কই? মেঘের পিছনে। বলেই ছুটে পালাল।


আমরা পায়ে পায়ে হাঁটা লাগালাম সেদিকে। প্রতিটি বাগান পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। স্থানীয় লোকেরাই দেখাশোনা করে। আখন অক্টোবর মাস। তাই কোন লেবুই পুরোপুরি পাকেনি। কিন্তু গাছ ভরা সবুজ পরিপুষ্ট লেবুতে বাগান ভরতি। বাচ্ছাদের খুব আনন্দ। নিচে ঝরে পরা অপুষ্ট লেবু কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কেয়ারটেকার তাই দেখে ওদের লেবু পেড়ে দিতে যাচ্ছিল। আমরা বারন করলাম। ওদের ত কুড়ানোতেই আনন্দ। ওনার কাছেই জানা গেল নভেম্বর মাস থেকেই লেবু পাকতে শুরু করবে। আর তখন এলে ‘যত খুশি পারো পাড় আর খাও’। স্থানিয় লোকেরা এইসময় জ্যাম, জেলি, রস, মারমালেড, আচার ইত্যাদি তৈরি করে বিক্রি করে। ইচ্ছামত কিনতে পারেন। শুধু তাই ই নয়, আমরা কল্পনায় দেখছিলাম উজ্বল কমলা রঙের গাছ ভরা লেবু শুদ্ধ বাগানটিকে কেমন দেখতে লাগবে।প্রধান সাহেবের দুই মেমসাহেব, বড়ামাঙ্গয়া ও ছোটমাঙ্গয়া। গ্রামটিতে ১৪/১৫ টি পরিবারের বাস। জনসংখ্যা সাকুল্যে ৬০-৭০। প্রতি পরিবারই মোটামুটি পর্যটন এর সাথে যুক্ত। খাদ্য শস্যর চাষ হয়না। সবটাই নীচ থেকে আনতে হয়। এখানে আদা ও এলাচ চাষ হয়। গ্রামের লোক পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ করে। নতুন প্রজন্মের সবাই সাক্ষর। বড়রা বাইরে পড়াশোনা করছে। এই পাহাড়ের পিছনে অপেক্ষাকৃত নিচু আর একটা গোটা পাহাড় জুড়ে ফল বাগিচা (Orchard).রীতিমতো Corporate Farmingএর কায়দায় চাষ। মুসাম্বি আর কমলালেবুর বিরাট বিরাট বাগান। সমতল থেকে ব্যাপারীরা এসে নিয়ে যায়।

সন্ধায় জমিয়ে ঠাণ্ডা ও সামান্য বৃষ্টি হল। চামেলিকে কষ্ট না দিয়ে আমরা ডাইনিং হলে খেতে গেলাম। মোটা হাত রুটি ও চিকেন কষা আর আলু চিপস খাওয়া হল। কোজাগরী পূর্ণিমার রাত। বাইরে ঘন অন্ধকার। আকাশ এখনও মেঘাবৃত। মনটা খারাপ হয়ে গেল।পাহাড় কোলে দামাল মেঘ / মেঘের বুকে জল -/ কোথায় কথায় কি হারালি / পাচ্ছিস না কি তল? রাতে টানা কাঁচের দরজা কাম জানালার পর্দা পুরো সরিয়ে দিয়ে কম্বল ঢাকা দিয়ে শুলাম।

কতক্ষন বাদে জানিনা, ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখি রাতের অন্ধকার সরে গেছে। তাড়াতাড়ি শাল জড়িয়ে বাইরে এলাম। একই সাথে পাশের ঘর থেকে আমার বন্ধুও বেরিয়ে এসেছে। দুজনে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। জ্যোৎস্না রাত বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। একদিকের আকাশে ঘন কাল মেঘ চাদরের মত বিছিয়ে আছে। চামেলির আঙুল তোলা আকাশে তখন ক্ষীণ রেখায় পাহাড় চুড়া দৃশ্যমান। আমরা বলাবলি করছি, আহা! মেঘটা যদি একটু পরিষ্কার হত! আকাশ শুনতে পেল নাকি! কয়েক মিনিটের মধ্যে মুখের কথা মুখে থেকে গেল। দুজোড়া চোখের সামনে কালো মেঘের পর্দাটা পিছনে সরে গেল। আরপাহাড় চুড়োয় পূর্ণিমা চাঁদ/ ডাকল আমায় হেসে – / ও মেয়ে! তুই করছিস কি?/ বল না হেথায় এসে। খেলার বল গড়িয়ে আসার মতো বিরাট চাঁদ, সোনালি না রূপোলী না সাদা, কি জানি কি রঙ, বেরিয়ে এল হাসতে হাসতে কালো মেঘের চাদর সরিয়ে। আর সাথে সাথে সমগ্র চরাচর দুধ সাদা আলোর বন্যায় ভেসে যেতে লাগলো। আকাশের গায়ে এতক্ষণ ক্ষীণ রেখায় যে পাহাড়চূড়া দেখা দিচ্ছিল এবার সে স্বমহিমায় নিজের বিস্তৃতি মেলে ধরল। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এত বড় করে, এত কাছ থেকে, এত বিস্তৃত ভাবে আর কখনও দেখিনি। কাঞ্চনজঙ্ঘা তার আসেপাশে আরও ছোটোবড়ো চারটি চুড়া নিয়ে আকাশের বুকে! জ্যোৎস্নায় তুষার কিরীট উজ্বল রূপোর মতো ঝকঝক করছে। কোজাগরীর পূর্ণচন্দ্র তার বাঁদিকে মাথার উপর স্থির। ডেকে বলছে যেন, আশ মিটিয়ে দেখ। আমাদের আর কোথাও যাবার তাড়া নেই। দলের বাকি সদস্যদের ঘুম ভাঙ্গানো হল। বাইরে এসে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। আমরা শোনালাম কেমন করে চন্দ্রোদয় দেখেছি। সবার অভিযোগ কেন তখনি তাদের ডাকিনি। বললাম না যে হটাত হয়েছে, বলতে পারতাম, ডাকতে গেলে আমরা দেখতে পেতাম না। বললাম, এর জন্য প্রেম চাই। আমাদের মত। প্রেমের জন্য আরাম কে বলি দিয়ে রাত জাগতে হয়। তবে প্রেম ‘সুন্দর’এর রূপ নিয়ে সামনে এসে ধরা দেয়।

তারপর অনেক রাত পর্যন্ত দেখে সবাই শুতে গেলাম। ঘুম ভাল হলনা। কারন ঘরের কাঁচের জানলা জুড়ে রয়েছে যে সে। আবার ভোর হবার আগেই সবাই বাইরে। বন্ধু ক্যামেরা নিয়ে আর আমি আমার সঙ্গী দূরবীক্ষণটিকে নিয়ে। আকাশ রঙ বদলাতে শুরু করেছে। সূর্য উঠবে কটেজের পিছন দিকে। একটু একটু করে তুষার কিরীট রঙ বদলাচ্ছে। সাদা, হাল্কা কমলা, আস্তে আস্তে গাঢ় কমলা, লাল – বর্ণনাতীত। viewing glass এ চূড়ার প্রতিটা ভাঁজ ও যেন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। একটা সময় এমন এল যখন কটেজের বারান্দার বাঁ কোণের রেলিংএ দাঁড়ালে একসাথে সূর্য ও চাঁদ দেখা যাচ্ছে।

এরপর সারাদিন ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘা একভাবে আমাদের সঙ্গ দিয়ে গেল। পরদিন ফেরার পালা। প্রধান সাহেব একটি করে ছোট উত্তরীয় পরিয়ে বিদায় জানাল। ফিরে চলা আবার রুটিনবদ্ধ জীবনে। আবার এখানে ফিরে আসব চাঁদনি রাতে কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে প্রেম করতে।

কাছাকাছি বেড়ানোঃ আসেপাশে অনেক জায়গা আছে কয়েক ঘণ্টায় যাওয়া যায়। মংপং ২১কিমি, পেডং ৩৬কিমি, ইত্যাদি।

যাওয়া – শিলিগুড়ি থেকে ৬১কিমি, নিজে গাড়ি ভাড়া করে বা রিসোর্ট মালিককে বলে।

বুকিং – net এ দেখতে পারেন। কোলকাতার অনেক ট্যুর কোম্পানি বুক করে। তবে সরাসরি প্রধান সাহেবের          সাথে যোগাযোগ করে বুক করলে অবশ্যই সুবিধা হবে।

ঠিকানা – M. K. Pradhan, Darjeeling Blossom Ecotourism Complex, Chhota & Bara Mangmaya Busty, P.O. Takling, Darjeeling, – 734312

Ph. No. : (M) 9800072639; 8972549897, 9332901041

Email: pradhan_mk18@yahoo.in

সময় – ঘোর বর্ষা বাদে সবসময়। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও গাছপাকা কমলালেবুকে একসাথে পেতে হলে নভেম্বর এর মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি হল উৎকৃষ্ট সময়। এসময় শীত বস্ত্র ভালই লাগবে।

বিশেষ অনুরোধ – কুমারী প্রকৃতির মর্যাদা রাখবেন। পানীয়ের বোতল, চিপসের প্যাকেট যত্রতত্র ছড়িয়ে আসবেননা। এগুলি নিয়ে যেতে যত জায়গা লেগেছিল ফিরিয়ে আনতে অত কষ্ট হবেনা বা জায়গাও বেশি নেবেনা। অভ্যাস করে ফেললে দেখবেন আমরা কত সহজে এই পাহাড়কে ক্রম বর্ধমান জঞ্জালের স্তুপ হওয়া থেকে বাঁচিয়ে ফেলেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here