এলান টুরিং ১৯১২ – ১৯৫৪ :
নীল অভিজিৎ–
***************************************
সময়টা তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জার্মান নাজিদের বানানো এনিগমা কোড, তখনকার সময় এক দুর্ভেদ্য উন্নত মানের কোডিং ব্যাবস্থা ছিল, যা হিটলার বাহিনীর বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য আদান প্রদানের জন্যে বানানো হয়েছিল। এই দুর্ভেদ্য এনিগমা কোডিং ব্যাবস্থা যেটা সম্পূর্ণ এনক্রিপটেড থাকত বা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে গণিতিক পরিভাষার সামাধানপদ্ধতি ও সংখ্যাবিস্তারে (মেথেমেটিক্যাল অ্যালগোরিদম) ভিন্ন এক মোড়কে মোড়া পদ্ধতি ।
সে সময়টা ১৯৪১ সাল, জার্মান নাৎসিদের দাপটে সারাবিশ্বে যখন ত্রাহি ত্রাহি রব, তখন এনিগমা-কোড ভাঙ্গার জন্য ইংরেজ নৌসেনা থেকে দায়িত্ব ভার দাওয়া হয় এলান টুরিং নামে এক মহান বৈজ্ঞানিক, যুক্তিবিদ, দার্শনিক, ব্রিটিশ গণিতজ্ঞকে । উনি ও ওনার কিছু সহযোগী কর্মীর দ্বারা টুরিং-টেস্ট এবং টুরিং-মেশিন সৃষ্টি করেন ও জার্মান নাজিদের বানানো দুর্ভেদ্য এনিগমা-কোডিং ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হন, যার জন্য ভবিষ্যতের জার্মান ডুবজাহাজ গুলো আক্রমণের পরিকল্পনা থেকে বিরত থাকে ও সেই মতো নিস্ক্রিয়ও হতে থাকে । পরবর্তি কালের বিশেষজ্ঞদের মতে সেই জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেয়াদ কম করেও, দুবছর কমে যায় এবং দুই কোটির বেশী মানুষ প্রানহানী থেকে রক্ষা পায় ।
এই মহান ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ এলান টুরিং একজন ম্যারাথন দৌড়বিদও ছিলেন, যার জীবনটা ভীষণই ভয়াবহ ছিল । বেক্তিগত জীবনে টুরিং একজন সমকামী ছিলেন, সেই সময় ব্রিটেনে সমকামিতা নিষিদ্ধ ছিল । ১৯৫২ সালে ওনাকে সমকামী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ওনার যাবতীয় গবেষণা মূলক কাগজপত্র ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেয় । কারন তখনকার দিনে খৃষ্টধর্মের প্রবক্তাদের মত অনুসারে সমকামিতা এক জঘন্যতম অপরাধ এবং সেই প্রভাবে ব্রিটিশ সরকারের মূখ্য বিচারালয় পর্যন্ত বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস পেত না । তাই দোষী টুরিংকে কিছুদিন কারাগারেও দিন গুনতে হয়েছিল । শেষে এই সর্তে টুরিং মুক্ত হন, হয় তাকে সমকামিতা হ্রাস করার জন্যে চিকিৎসায় সম্মতি প্রদান করতে হবে অন্যথায় কারাজীবন ভোগ করতে হবে, শেষমেশে উনি চিকিৎসা পদ্ধতিকেই বেছে নেন ও দেশের স্বার্থে পুনরায় এন. পি. এল কার্যশালায় যোগ দেন এবং এইসের (ace) নকশা তৈরি করেন ।
আজকের দিনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সি এবং কম্পিউটার বিমূর্ত গানিতিক গঠন, কম্পিউটার প্রকৌশলী ওনারই সৃষ্টি, কম্পিউটার বিজ্ঞানে আজ টুরিং পুরষ্কারকে প্রায় নোবেল পুরষ্কারের সম-সম্মানে দেখা হয় । শেষে চিকিৎসার মাধ্যমে ওনার সমকামিতা যদিও হ্রাস পায় এবং সেই জন্যে ১৯৫৪ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে টুরিং আত্মহত্যা করেন । অনেকের ধারনা টুরিং নিজেকে সমকামিতায় অক্ষম মনে করার জন্যেই মানসিক বিকারে ভুগছিলেন, ওনার মেধা ও স্মৃতিশক্তি আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পায়, আর সেই জন্যেই টুরিং আত্মহত্যা করেন । যাইহোক বিষয়টা অতি দুঃখজনক, কারন আজকের দিনে ব্রিটেন সমকামিতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বর্তমানে কালে অনেকেই বলে থাকে যদি, সেই সময় গ্রেট-ব্রিটেন সমকামিতাকে স্বীকৃতি প্রদান করত, তাহলে এলান টুরিং এর মতো মহান গণিতজ্ঞ বিজ্ঞানী, যুক্তিবিদ, দার্শনিক, ক্রিপ্টো-বিশেষজ্ঞ মাত্র ৪২ বছর বয়সে আত্মহত্যা করতেন না । ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন টুরিং এর ক্ষতিকর চিকিতসায় বাধ্য করার জন্যে দাপ্তরিক ভাবে ক্ষমা পার্থনা করেন, এছাড়াও ২০১৩ সালে রানী এলিজাবেথ মরণোত্তর ক্ষমা প্রদান করেন।
সাম্প্রতিক হলিউড মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি “দ্য ইমিটেশন গেম” এলান টুরিং এর জীবনী নিয়ে তৈরি একটি সুন্দর ছবি যেটি ইউ. এস. এ একাডেমী পুরস্কারও লাভ করে । সমস্ত পৃথিবী জুড়ে সব সময় সমকামীদের ঘৃণা করা হয়েছে, একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে । সমকামিতা, রূপান্তরকামিতা এগুলি এখনও আধুনিক সমাজে বিকৃত রুচি সম্পন্ন বলে মনে করে । আমার মনে হয় এটি মানুষের স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে থেকে একরূপ যৌন আবেদন, সেটা তখন সেই বেক্তিটির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এটাকে মনবিকার বা মনোবৈকল্য বা বিকৃত রুচি বলে মনে না করলে এলান টুরিং এর মতো অনেক প্রতিভাধর বেক্তিদের আমরা সমাজ অগ্রগামীর জন্যে শ্রেষ্ঠ উপযোগে নিয়োগ করতে পারতাম । এলান টুরিং কে যখন মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তখন তার পাশে সাইনাইড মিশ্রিত আধ খাওয়া একটি আপেল পাওয়া যায়, পরবর্তি কালে স্টিভ জবস, যা অ্যাপেল কম্পিউটারের নিজস্ব লোগো হিসাবে বেছে নেন । এলান টুরিং যদি আরও কিছু দিন বেশী বেঁচে থাকতেন আমাদের কম্পিউটার বিজ্ঞানে আজ আরও বেশী উন্নতি হতো, সে কথা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি ?
*************************
নীল অভিজিৎ~ 01/07/2017