হারিয়ে যাওয়া সুর
অবন্তিকা সান্যাল
ছেলেবেলার বেড়ে ওঠা পাড়ার গলিটাতে সবার বাড়িতেই একটা দুটো ক’রে বাচ্চা থাকতো। বেহিসেবি সন্ধ্যে গুলোয় কিম্বা ছুটির দিনের সকালে কাঁচা হাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে তারস্বরে সারেগামা ছিল অতিসাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার। কখনো সখনো কান পাতলে একজন মাস্টারমশাইয়ের গলাও পাওয়া যেত। মনে হত সব বাড়ির মাস্টারমশাইয়ের গলার স্বর যেন এক। আমার দেখা দেখি, আমাদের ওপর তলার ডোনাও গান শেখা শুরু করল। ওদের কলকারখানার ব্যবসার বাড়িতে দুম করে ঢুকে পড়ল একটা হারমোনিয়াম। জন্ম থেকে ব্রংকাইটিসে ভোগা ঘড়ঘড়ে কফওয়ালা গলায় ডোনাও শুরু করলো গলা সাধা।
নীচের একতলার তেলুগু ভাই বোনেরা প্রতিদিন সন্ধ্যে হলেই একটা মাঝারি হোমিওপ্যাথির বাক্সর মত হারমোনিয়ামে সা-পা টিপে ভজন করত। আমিও কচি অবস্থায় ফ্রক পরে ওদের ঘরর বসে ঘন্টা নাড়তাম। আমি বয়সের তুলনায় বেশ পাকাপোক্ত গান করতাম। খুব ছোটবয়স থেকেই বড়দের মত কায়দা করে হারমোনিয়াম বাজাতে পারতাম। আমার মাস্টারমশাই সেই জন্যে মায়ের সঙ্গে কথা বলে একজন তবলচি ঠিক করে দিয়েছিলেন, যাতে তালিমটা আরো ভালো হয়। এরই মধ্যে একদিন মা আর গানের মাস্টারমশাই, যাকে আমি গানের কাকু বলেই সারা জীবন ডেকেছি,আড়ালে শিখিয়ে দিয়েছিল, সেই তবলা বাজাবার ভদ্রলোকটিকে তবলচি বলতে নেই, তাতে নাকি তাঁর অসম্মান হয়। মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিল সেদিন, তাঁকে তবলিয়া বলে সম্বোধন করতে হয় সর্বসম্মূখে। তার কিছুদিন পরপরই আমাদের বাড়িতে তবলা এলো। প্রতি বিকেলবেলায় আমার যে কটা খেলার সঙ্গি ছিল সবাই হুড়মুড় করে এক বিকেলে তবলা বাঁয়া দেখতে এলো। তাদের মধ্যে ওই নীচের তেলুগু বাড়ির একটা ট্যাঁরা ছেলে ছিল। নাম ভরত। সে আনাড়ি হাতে চাঁটি মেরে নতুন তবলাতে আমাদের মধ্যে এককথায় হইচই ফেলে দিল। সেই থেকে প্রতিদিন বিকেলে সব হুড়োরদল এসে হাজির হত আমাদের বাড়িতে। কার বাড়ির দুধের ডাবু হাতা দিয়ে বাঁয়ায় দুম দুম করে ঠেঙিয়ে ভরত হয়ে উঠল আমাদের দলের ড্রামার। কুকুর তাড়ানো চিৎকার করে চলত আমাদের সংগীতের মহাসভা। সে এক মস্ত অধ্যায়।
তারপর খানিকটা বড় হ’লাম। বাবা বাড়ি কিনে চলে এলো পাশের গলিতে। ক্লাস নাইনে উঠেছি তখন। কেতাদুরস্ত স্কুলে পড়লেও অতবড় মেয়ে! ধিঙিপনা করে এর ওর বাড়ি খেলতে যাবে কারো বাড়িতেই সহ্য হত না। রবিবারের মাংসর গন্ধের মত সেই গান গাওয়া, সারেগামা করা ছেলেপুলে গুলো সব যেন উবে গেলো। নতুন গলিটা বরাবরই আমার কাছে পর, কারণ এখানে কোনো শিশু নেই, সবাই মস্তবড়ো। নানাবিধ সমস্যা ও পিতৃপুরুষের দ্বারা ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া কোটি টাকার সম্পত্তির জোয়াল টানতে টানতে এই গলির মানুষগুলো কেমন ক্লান্ত, প্রাণহীণ। তবু এরই মাঝে সামনের রায়বাড়ির একটা ছোট্ট মেয়ে তিতলি রোজ নিয়ম করে গলা সাধতো। তার মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রবিঠাকুরের গান গাইত, বিশেষ ক’রে ওই গানটা, ‘তোমারি গেহে পালিছে স্নেহে…..’। আর যেমনি আমি আমাদের বাড়ি থেকে সা বলা শুরু করতাম মেয়েটি চুপ করে যেত। আমি প্রথম প্রথম একটু অবাক হতাম। ভাবতাম ওর বুঝি রেওয়াজ শেষ। ওমা ! তার পর পরই যেমনি আমি একমিনিট দুমিনিট করে বিশ্রাম নিতাম গানের ফাঁকে, সেই তিতলি জোর দিয়ে গান ধরত। আমি দুষ্টুমি করে ইচ্ছে করে থেমে দেখতাম কি হয় এবার। এক সেকেন্ড ও যেত না, সেই তিতলি আবার গান শুরু করত। তারপর দিনে দিনে আমার গানের বহর বাড়তে থাকলো। একটু একটু করে এদিক ওদিক ডাক। কত জলসা, অনুষ্ঠান, টিভি, আরো কত হইচই। দিনের চব্বিশ ঘন্টার বোধয় আট ন’ ঘন্টা শুধু আমাদের বাড়ি থেকে গানের আওয়াজ যেত পাড়ায় ছড়িয়ে। কত অচেনা প্রতিবেশী মা বাবার সঙ্গে এসে আলাপ করে গেছে আমাদের বাড়িতে গানের অমন চল দেখে। সেসব কত না কথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও যেন কোন কুক্ষণে আইন পড়ার জালে জড়িয়ে পড়লাম। তবুও গান চললো একই ভাবে। তারপর আরো পড়া, আরো পড়া আরো পড়া……বাঙালি বাড়ির এ হেন চল যে কত গুণের কবরস্থান, সে শুধু মাত্র অন্তর জানে। মানুষ সব জেনে শুনেও কখনো কখনো চোখ বুজে পথ চলে। আমিও সেই রকমই বোধহয়। কোন অজান্তেই একদিন টের পেলাম সেই ছোট্ট তিতলির গান বন্ধ হয়ে গেছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে, সন্ধ্যে ফুরিয়ে রাত কিন্তু গান আর ভেসে আসেনা।উপলব্ধি হল, আমি এখন রোজ কোর্টে যাই, প্র্যাক্টিস করি আর সেই ছোট মেয়েটি এখন কলেজের গন্ডি পেরোচ্ছে। বিশ্বাসের হাতে গড়া আমার ঐতিহাসিক স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম টা এখন একটা সাজানো বাক্সে বন্দি। আরেকটা হারমোনিয়াম যেটা দিয়ে আমার গানের হাতেখড়ি, সেইটা ঠাকুমা বালিগঞ্জ স্টেশন এলাকার একটা দোকান থেকে কিনে দিয়েছিল টাকা জমিয়ে, সেটাও ধুলোর প্রেলেপে রূপ বদল করেছে।
আজ যখন নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও সকালে খবরের কাগজটা নেড়ে চেড়ে দেখছি, ইংরিজি দৈনিকে বিশ্ব সঙ্গিত দিবসের জন্যে নানা অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, হঠাৎ কানে এলো বেসুরো হারমোনিয়ামের আওয়াজ। ভুলভাল রীডে হাত পড়ে গেলে যেমনটা হয় ঠিক তেমন। একটু ভালো করে কান পাতলাম। মনে হচ্ছে যেন আমাদের বাড়ির কোনো আনাচে কানাচে বাজছে শব্দটা। কাগজটা বারান্দায় ফেলে উঠে গেলাম ঘরের দিকে। এইত্তো, আরো কাছে আসছে সুরটা। বসবার ঘরের দরজা পেরিয়ে লম্বা বারান্দা। কিন্ত বাঁদিকে তো রান্না ঘর। ওখান থেকে সুরটা আসছে না তো। আরো একটু এগিয়ে গেলাম সিঁড়ির কোল্যাপ্সেবল গেটের কাছে। সুরটা আরো যেন তীব্র লাগছে। খালি পায়ে নেমে গেলাম। এবার ঠিক ধরে ফেলছি মনে হচ্ছে সেই আনাড়ি সুরটাকে। আরো একটু নেমেই দেড় তলার ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলেই দেখি আমাদের ঠিকে কাজের মেয়ে কল্পনা অতি যত্নে আমার বাজনা গুলো মুছে দিচ্ছে আর কৌতুহলের বশে বেলোটা টেনে একটা একটা ক’রে রীডে আঙুল বুলিয়ে চলেছে। এতগুলো দিন পরে ওই আনাড়ি আঙুলের সুর বা বেসুর সে যাই হোক না কেন, তাতেই যেন উদযাপিত হচ্ছে পৃথিবীর সংগীতের মহাদিন, ক্যানিং পারের এক নিরক্ষরের হাত ধরে। বিনা নোটিশে নতুন করে জেগে উঠেছে, সেজে উঠেছে আমার সবচেয়ে প্রিয় ঘরখানা। ওই ধুলো পড়া যন্ত্রের মধ্যেই যেন আবার ফিরে এসেছে আমার পুরোনো পাড়ার হারিয়ে যাওয়া হুড়োর দল, বাঁয়া পেটানো ভরত, উবে যাওয়া ডোনা, আলেখ্য আর নতুন পাড়ার সেই ছোট্ট তিতলি
************************