পথ ----- ২৯ ----------------- হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে এক বৈকালিক আড্ডায় আমি জানতে পারি, তাঁর পিতা বিজন ভট্টাচার্য মনে প্রাণে চেয়েছিলেন তার সন্তান সাহিত্যিক হোক। এর সূত্র ধরেই নবারুণদা বলে উঠেছিলেন, " আজকের বাবা মায়েরা এমন চাওয়া চাইতে পারবে ? " ------- "হ্যাঁ, পারবে ।" ------- " কে তিনি ?" ------- " আমার বাবা ।" বাবাকে কী ভীষণ অভাবের মধ্যে দিয়ে সংসার চালাতে হয়েছে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে যে কোনো পিতাই চাইতে পারত তার ছেলে চাকরি করুক। এটা কোনো দোষের নয়। কারণ সে নিজে প্রতি মুহূর্তে যে ভয়ঙ্কর অভাবের মুখোমুখি হচ্ছে তার সন্তান সেই অভাব থেকে বেরিয়ে আসুক ----- এই স্বপ্নকে যে কোনো পিতাই প্রশ্রয় দেবে। খুব ছোটবেলা থেকেই আমার লেখার শুরু। আমার এই কাজকে বাবা খুব পছন্দ করত। বাবা যখন রাতে গল্প করে ফিরত, তখন হাতে করে একটা খবরের কাগজ নিয়ে আসত। যে দোকানে বাবাদের আড্ডা চলত সেই দোকানেই কাগজটা নিত। সারাদিন কত কত মানুষ ওই কাগজটা পড়ত। বাবা দিনের শেষে ওটা আমার জন্য নিয়ে আসত। এখানেই শেষ নয়। বাড়ি ফিরে আমাকে দেখিয়ে দিত আমি কোনগুলো পড়ব। আমি একদিন বাবাকে একলা পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "আমার এই লেখক জীবনে তোমার কি কোনো সমর্থন আছে?" "পূর্ণ সমর্থন। আমি চাই না তুই চাকরি করিস। চাকরি তো সবাই করে। এর মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। আমাদের চারপাশে আমরা ক'জন লেখককে দেখতে পাই? তুই লেখক হলে আমি শান্তি পাব।" সেদিন বুঝেছিলাম মানুষটার কি ভীষণ মনের জোর। কতখানি সাহস থাকলে তবে একজন বাবা তার ছেলেকে এই পেশায় ঠেলে দিতে পারে! প্রাইভেটা টিউটরের মাইনে বাবা কোনোদিন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দিতে পারত না। শিক্ষকরা যাতে অখুশি হয়, আমাকে কথা শোনায় তাই বাবা পড়া শুরুর আগেই কথা বলে আসত। নিজের আর্থিক অবস্থার কথা একটুও না লুকিয়ে সবটাই জানাত। এইধরনের আবেদন করার সময় তার মাথা উঁচু থাকত। নিজের আর্থিক অবস্থার জন্য বাবাকে লজ্জা পেতে দেখে নি। বাবা বলত, "আমি তো চুরি করছি না। লড়াই করে সৎভাবে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর তাছাড়া শিক্ষার জন্য কোনো কিছু চাওয়া লজ্জার নয়।" আজ আমার ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকরা যারা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে আছেন তাদের প্রত্যেককে আমার বাবার গল্প শোনাই। সংসার সংগ্রামে এক আপোষহীন সৈনিকের আমৃত্যু লড়াই।
হরিৎ : 03/07/2017
******************