Home ঘুরে আসি সুন্দরী সিকিম ~ ঘুরে আসুন পৃথিবীর স্বর্গ সিল্করুট

সুন্দরী সিকিম ~ ঘুরে আসুন পৃথিবীর স্বর্গ সিল্করুট

সুন্দরী সিকিম ~  ঘুরে আসুন পৃথিবীর স্বর্গ সিল্করুট

বেড়ানোর একটা নেশা আমার রক্তের ভিতর ঐ পরিব্রাজক হিউ-য়েন সাঙ ও ফা হিয়েন চাউমিনের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন কিনা জানা নেই। তবে সিল্করুটের কথা শুনলেই আমার মনে হয় আমার সেকেন্ড হোম – সিকিমের সিল্করুট। মনটা পালিয়ে যেতে চায়। শহরের ভীড়, গরম, কাজের চাপ প্রায়শই আমার দমবন্ধ করে দেয়। চেনা পরিবেশের পরিস্থিতিকে পেরিয়ে, এড়িয়ে মানুষের মুখ আমি পালিয়ে যাই। আমার দ্বিতীয় বাসস্থান সিকিম।

ঘড়ির সময় বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমিও বুড়ো হচ্ছি। তবু মনের অবসর শান্তির আলাদা এক লোভ রয়েছে। সেই লোভ যে সামাজিক ও পারিবারিক বাঁধনের অনেক উপরে। ভ্রমণ হয়ে ওঠে এক সামাজিক নেশা। কাউন্টডাউনের প্রতিদিন পেরিয়ে তাই এবার আমার ব্যাগপ্যাক বলছে তুমিও পরিব্রাজক। মনে হচ্ছে বিশ্ব যেন আমার ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা নিয়ে চলেছে আমার সাথে। হাওড়া থেকে জলপাইগুড়ির ট্রেন।

Image result for sevoke bridge

তারপরেই গাড়িতে পূর্ব সিকিম। যাওয়ার রাস্তাটাই প্রচন্ড সুন্দর। সকলেই জানেন। যারা তিস্তা দেখেছেন, যারা একবার এই পথের ধারে দাঁড়িয়েছেন তারা জানেন। হোক না জাতি কোন্দল তবু আমার চোখ তো অর্জুনের মতোই সিকিমে। আমাকে তো পূর্ব সিকিমে পৌঁছাতেই হবে। আমায় তো মন থেকে টানছে সিল্ক রুট।

আসলে এই যে সিল্ক রুটের কথা বলছি তা পূর্ব সিকিম এবং অধুনা তিব্বতের লাসা-কে সংযুক্ত করেছে নাথুলা এবং জেলেপ লা পাস-এর মধ্য দিয়ে। সিল্ক রুটের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সুপ্রাচীন। আসলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সভ্যতার যে বিনিময় – বিশেষ করে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান, চীনা, ভারতীয়, ফার্সি, আরব, সংস্কৃতির আদান প্রদান করা। সেই সিল্ক রুট ও তার আশেপাশের অনন্ত পরিবেশ ও উপত্যকা আমার ভিউফাইন্ডারে ভ্রমণের তালিকায়। অনেকবার সিকিমে এসেছি। সে তো গ্যাংটক বা পেলিং-এর ঐ দিকটা। সিল্করুটের মোহটা অনেকদিন ধরেই ছিল। তাই নতুন স্থান, অল্প জানাকে অনেকটা জানার লোভে এইবার এইদিকে।Image result for silk route sikkim

আমিও এবার পরিব্রাজক, স্বপ্ন দেখার চোখ

সিল্করুটের এই স্বপ্নরা এবার সত্যিই হোক।

সিলারি গাঁও

Image result for sillery gaon

আমি যেমন করে ম্যাপটাকে বানিয়ে নিয়েছি তাতে আমার প্রথম গন্তব্য সিলারি গাঁও। সাধারণত শিলিগুড়ি থেকে ঘণ্টা চারেকের পথ। কিন্তু রাস্তায় চা ও ব্রেকফাস্ট করে সহযাত্রীদের এটা ওটা নানা সমস্যা মানে (ভমিটিং টেন্ডেন্সি) পেরিয়ে মোটামুটি পাঁচ ঘণ্টা লেগেই গেল। পাহাড়ের শরীর জুড়ে সর্পিল পাক দন্ডির রাস্তা দিয়ে, তিস্তার মনোরম স্রোতকে সঙ্গী করে, নিবিড় সবুজ পাশে শাল, সেগুন গাছের সারি ভেদ করে মোহময়ী যাত্রাপথ। সুদূরের দেখা যাচ্ছে পাহাড়ি বাড়ি। ধাপে ধাপে অসংখ্য চাষ জমি। তবে পাহাড়ি এই ড্রাইভারের নিয়মানুবর্তিতা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়।Image result for sillery gaon

 

সিকিমের প্রতি পাহাড়ের কোলে ছোট্ট জনপদ বা গ্রাম সিলারি গাঁও। শহুরে আদবকায়দা ছাড়া হলেও আন্তরিক হোমস্টে আপাকে এখানে আলাদা শান্তি দেবে। ভীড় নেই, চিত্কার নেই, নেটওয়ার্ক নেই মোবাইলের ভাল করে, অন্য এক জীবন। প্রকৃতির সাথে শান্তিতে উপভোগের আদর্শ স্থান সিলারি গাঁও। আলাদ স্পষ্ট ভেবে এখানে মিলিয়ে দেখার কিছু নেই তবে যাই দেখছেন বা দেখবেন তাই অনন্য। কারণ এখানে তো প্রকৃতি তার নিজের মতো থাকে। এখানে তো শহরের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কিছু হয়নি। হবেও না। এ এক প্রকৃতির স্নিগ্ধতা। পাহাড়ে এদিক ওদিক মেঘের কোলে, গাছগাছালির ছত্রছায়ায় অদ্ভুত এক স্থান। এদিকে সেদিকে ঘুরে বেড়ানো, নিজের সাথে নিজের কথা বলা ও প্রকৃতির সাথে একাত্ব হয়ে হারিয়ে যাওয়ার অজস্র উপকরণ এখানে রয়েছে। একটু নিরালায় স্নিগ্ধ দিনে নিজেকে সময় দেওয়া। ব্যালকনিতে এসে বসলে হাতে চায়ের কাপ থাকবেই সেই সঙ্গে পাহাড়ের বুক জোনাকির মত আলোর বিন্দুরা অলস সন্ধ্যেতে মন পাগল করা গান গেয়ে উঠতেই পারে। একটু ক্যাম্প ফায়ার হয়ে যেতেই পারে। অজানা জংলী ফুলের মাঝে সুন্দর পাহাড়ি মানুষে আপনিও ভুলে যাবেন আসলে আপনি কে…

Image result for sillery gaon

অজানা মানুষের সাথেই আমাদের প্রচেষ্টা থাকে ক্যামেরার ফ্রেমে সমস্ত সৌন্দর্যকে ধরে রাখব। নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়। তাদের জানতে চাওয়া। আসলে মানুষ তো মানুষের সাথেই মিশে থাকতে চায়। এখনও ট্যুরিস্টের ভিড় এখানে কম। তেমন পরিবেশ নষ্ট হয়নি। অকৃত্রিম এক মেঘ পাহাড় এখনও এই স্থানের প্রধান আকর্ষণ।  

 

পাহাড় মেঘে জংলী ফুল, পাইন গাছ – আমাকে নাও

মন পাগলের অলিপথ ধরে আজও ডাকে সিলারি গাঁও।

 

ম্যাজিশিয়ান এখানে প্রকৃতি নিজেই। তার জাদুদন্ডে সকালের রূপ সৌন্দর্য অবিস্মরণীয় এক সকাল। জাদুর স্পর্শে ধীরে ধীরে আকাশে আলো এলো, প্রকৃতির পর্দা সরে গিয়ে এক লহমায় দেখা দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। আরও অনেক বরফ ঢাকা শৃঙ্গ।

Image result for sillery gaon

সিলারী গাঁও-কে টাটা করে আজকের যাত্রা আরিতার। বৃষ্টি ভেজা মেঘবালিকা রোদের জলছবির মাঝে লুকিয়ে যায় আর আমিও আহা ঐ আকাবাঁকা পথ গাইতে গাইতে কালিম্পং ছেড়ে ঢুকে পড়লাম সিকিমে। মাঝে ছিল ঋষি খোলার পাড়ে সামান্য সময়ের বিরতি। আমাদের গাড়ি সাঁকোর গা বেয়ে দাঁড়িয়েছিল, পাথরের অমসৃণ রাস্তায় হেঁটে, জোঁকের আক্রমণ এড়িয়ে নদীর পাড়ে ট্রেকিং করে ঘুরেই এলাম। এছাড়াও লোকাল দোকানে কালিম্পং-এর ক্ষীরের “একমেব অদ্বিতীয়ম” ললিপপ-এর স্বাদও নিলাম। ভেড়ার দুধ দিয়ে তৈরি, যদিও স্বাদ তেমন ভাল লাগল না।

 

আরিতার

Related image

মানখিম থেকেই আরিতার লেক-এর নয়নাভিরাম দৃশ্য নজরে এলো। পাহাড়ের উপর ভিউতেই জঙ্গল পরিবেষ্টিত পাহাড়ের কোলে ছোট্ট লেক সত্যিই মনোমুগ্ধকর। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘবালিকা ছোঁয়ায় তা অদৃশ্য। এ এক অপরূপ দৃশ্য।  তারপরে সামনাসামনি লামপোখারি লেকের (আরিতার লেকের আসল নাম) সাথে দেখাও হল। মেঘবালিকার সাথে-রোদ্দুরে খেলা চলে কিন্তু রূপসী নীল নদী যে তার সমস্ত রূপের ডালি উজাড় করে দিয়েছে আমাদের জন্যই।

Image result for aritar lake

মেঘপিয়নের সাথেই দৃশ্য মুখর আরিতার লেক,

মানুষের দল মায়াবী আলোয় মানুষ হতে শেখ।

আরিতার এর রিসর্টটা ব্যাপক সুন্দর। যদিও পাহাড়ের কোলে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তবু এখানে পাহাড়ের বুকেও নাগরিক স্বাচ্ছন্দের ভরপুর আয়োজন। অদ্ভুত লোকেশন। ঘরে বসেই জানালা দিয়ে কিংবা লাগোয়া ব্যালকনি থেকেই দেখা যায় ঢালু সামনের খাদ, বিস্তীর্ণ উপত্যকা, দূরের পাহাড় শ্রেণি।

Image result for aritar lake home stay

হোমস্টের মালিক খুবই মিশুকে, প্রতিটি অতিথির সাথে আলাপ করাই তাঁর শখ। বাঙালি রান্নার ঠাকুর এনেছেন অতিথিদের স্বাদু আপ্যায়ন জন্য কারণ বাঙালি পর্যটকই বেশি। তার নিজের অর্কিড গার্ডেন আর পাহাড়ের ঢালে বিস্তৃত চাষবাস, সবটাই নিজের।  ঢালু পাহাড়ি জঙ্গল ঘেরা বাড়িটি ঘিরে চমৎকার গোয়েন্দা বা ভৌতিক উপন্যাস লেখা কোনও অস্বাভাবিক বিষয় নয়।  এই দূর্গম পাহাড়েও অনন্ত আয়োজন সত্যিই প্রশংসা করারই মতো।

 

ইয়াকতেন

Image result for yakten sikkim

ঘন্টা তিনেকের পথ পেরিয়ে এলেই ইয়াকতেন। তবে পাকইয়ং-এ ঘন্টা খানেকের বিরতি। উদ্দেশ্য নারায়ন প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ। তিনিই আমাদের পূর্ব সিকিম ভ্রমনের আর্কিটেক্ট। তাঁরই হাত ধরে প্রতিটি জায়গার হোমস্টে বুকিং, যাতায়াতের সর্বক্ষণের গাড়ি, খাওয়া-দাওয়া এবং দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ একই সূত্রে বাঁধা। খুবই ভাল, সুন্দর কথা বলেন, বিনীত ও অতিথি বৎসল হাসিমুখ। তার সাথে মুখোমুখি সাক্ষাতের উপরি পাওনা ওঁনার বাড়ির ঐতিহাসিক মিউজিয়াম দেখলাম। আসলে ওঁনার দুশো বছরের বেশি সময় আগের কাঠের বাড়িটাই তো চলমান ইতিহাস।

 

নারায়ন প্রধান সে বাড়ির অষ্টম প্রজন্ম। বিভিন্ন অ্যান্টিক জিনিসের সমাহারে শোভিত তাঁর ঘর। সেখানে গণ্ডারের শিং, পাইথনের চামড়া যেমন আছে, আবার অন্য দিকে তেমনি রয়েছে পুরনো রেডিও, গ্রামোফোন, লণ্ঠন, মুদ্রা বানানোর মেশিন, বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাম্প ইত্যাদি। পাকইয়ং থেকে ইয়াকতেন যাবার পথে দেখলাম নির্মিয়মান সিকিমের বিমানবন্দর।

Image result for yakten village sikkim

ইয়াকতেন একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ের কোলে, মেঘ আর সবুজের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে ভিলেজ ট্যুরিজম। “কোঠেবাড়ি” আজ আমাদের আশ্রয়। এ কোঠেবাড়ি সেই বাঈজী নেই, আসলে হোমস্টের আদুরে নামকরণ। এখানেই শহুরে মানুষের বিনোদনের সান্ধ্যকালীন মনোরঞ্জনের ক্যাম্প ফায়ার, বারবিকিউ, আদিবাসী নৃত্য ইত্যাদি।

পাহাড়ি গাঁও ইয়াকতেন বলছে নিরুদ্দেশের কথা

জীবনদেবতার নিজের দেশে স্নিগ্ধতাই নীরবতা।

ইয়াকতেনে ইয়েতি

সত্য ইয়েতি। একটা আলাদা মজার বিষয়। আসলে চল। কথারা গল্প বানায়। তাই চলতে থাকে। সত্য ইয়েতি দেখলে তো জীবনই সার্থক হয়ে যেত। এমনি লেখক মন জেগে উঠল তাই ই যোগে ইয়েতির কথা লিখে ফেললাম। পরের দিন সকাল পাঁচটায় “ঝান্ডি দাঁড়া” গেলাম ট্রেক করে। অসাধারণ “ভিউপয়েন্ট”।

Image result for jhandi dara sunrise point

অনেকের মাউন্ট এভারেস্টের মাথায় যেতে চান। কিন্তু সেই সাহস ও মনোবল থাকে না। এই ঝান্ডি দাঁড়া ট্রেক করে স্বাদ মিটিয়ে নিতেই পারেন। প্রথমে গেলাম “সরমসা গার্ডেন”। ছোট্ট পাহাড়ি নদী রানীপুলের ধারে বিভিন্ন গাছগাছালি, ফুল ও ফলের রঙ তুলিতে এক ছিমছাম বিস্তীর্ণ বাগান। যদিও প্রাকৃতিক নয়, বানানো কৃত্রিম ভাবে খুব যত্নে। আসলে অনেকটা গ্যাংটক বা দার্জিলিং এর “ফাইভ / সেভেন / টেন পয়েন্টস” এর ধাঁচে নতুন একটা “স্পট” গড়ে তোলার চেষ্টা। বোঝাই যাচ্ছে পাকইয়ং এ বিমানবন্দর চালু হলে ইয়াকতেন কে কেন্দ্র করে পর্যটন এর জোয়ার আসতে চলেছে। তার প্রচেষ্টার ছাপ সব স্থানেই দেখতে পেলাম- পরিকাঠামো, রাস্তাঘাট, পর্যটন পরিকল্পনা, কর্মসংস্থান প্রভৃতি।

Related image
পরের গন্তব্য রুমটেক মনাষ্ট্রি। আগেও এখানে গ্যাংটক থেকে এসেছি। তবে ঢুকতে পরিচয় পত্র লাগল। ভিতরে বৌদ্ধ মতে পূজা-পাঠ চলছে দলবেঁধে, সারি দিয়ে। বৌদ্ধ লামারা তাদের গভীর মনসংযোগে পুজো করেই চলেছে। ভগবান বুদ্ধের মূর্তির ধ্যানমগ্ন স্মিতহাস্যময় স্থিতধি মূর্তি দেখে সত্যিই মনে হল “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”। ইয়াকতেন-এ সন্ধ্যা নেমে এলে অনেক বেশি স্নিগ্ধ-আকর্ষণীয় ও মোহময়ী মনে হয়। এখান থেকে গ্যাংটক সহ সিকিমের সকল জনপদ যেন আলোর পিদিম জ্বালিয়ে ফুটে উঠছে আলোকবর্ষ দূরে।

রোলেপ

Related image

আজ ব্রেকফাস্ট করে ইয়াকতেন ছেড়ে গন্তব্য রোলেপ। আজ সকালে মোমো খেয়ে মনটা খুশ হয়ে গেল। ইয়াকতেনে পুরোটাই সুব্বা জনগোষ্ঠীর বাস। ওঁনাদের আত্মীয় পরিজন মিলেই আটটি হোমস্টে গড়ে উঠেছে সরকারী সহযোগীতায় প্রায় বছর তিনেক আগে। ওঁনাদের জমি, সরকারের বানিয়ে দেওয়া পরিকাঠামো এবং পারিবারিক পরিচালনা। চারপাশে চাষবাস চলছে ফুল, ফল ও সবজি। শীতকালই আদর্শ সময় এখানে আসার। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইয়াকতেন ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেছে। ইয়াকতেন থেকেই আমাদের সারথি লুকান তামাং আগামী কয়েকদিন তার বোলেরো গাড়ি নিয়ে।

Image result for rolep

ভারী মিষ্টি স্বভাবের ছেলে, সদা হাস্যময় ও যে কোন সাহায্যের জন্য দুইপা বাড়িয়ে। ইয়াকতেন থেকে রওনা দিয়ে সে প্রথমেই নিয়ে গেল তার গ্রাম নয়া বস্তি। ইয়াকতেনে থাকার ব্যবস্থা রেখে এই অঞ্চলে বিভিন্ন ভিউপয়েন্ট, পার্ক, ট্রেকিং রুট, পিকনিক স্পট, গার্ডেন ইত্যাদি বানানোর কর্মযজ্ঞ চলছে জোড় কদমে। আমি মানসচক্ষে স্পষ্ট বুঝতে ও দেখতে পেলাম, দার্জিলিংয়ের মতো ভীড় এখানেও হবে। পথে পড়ল কার্তন মনাস্ট্রী। খুব পুরোন, অসাধারন প্রাকৃতিক পরিবেশ আর সবচেয়ে বড় কথা হামলে পড়া ভীড় নেই।

 

Image result for silk route sikkim

রোলেপ পৌঁছলাম প্রায় দুই ঘন্টা পাহাড়ি পথ বেয়ে। এখানে গাড়ি চলার রাস্তা শেষ যদিও আমার আস্তানার খোঁজ তখনও মেলেনি। মোবাইলে সিগনাল নেই। কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল সিড়ির ধাপ এখানে রাস্তা  শেষ সিড়ি রয়েছে। মনে হল সেটি নদীর দিকে, সেই সিড়ি বেয়ে, সাঁকো নদীর মুখে পৌঁছতেই “চিচিং ফাঁক” আবিস্কার করলাম নদীর পাড়েই বাসস্থান। নদীর নাম “লুম্ফু খোলা”, অনেকে একে “রোলেপ খোলা”ও বলে। ছাঙ্গু লেক থেকে শুরু হয়ে তিস্তাতে গিয়ে মিশেছে এ নদী।

Image result for rolep

নদীর রূপ এখানে ভয়ঙ্কর। প্রায় তিন-চার দিক থেকে পাথরের বুক চিরে আছড়ে পড়ছে জলরাশি এবং বিভিন্ন পাথরে ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে চলেছে রুদ্র মূর্তিতে। ব্যালকনিতে বসেই এহেন নদীর যাত্রা, কারসাজি, গান ইত্যাদিতে মগ্ন হয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় বেশ কয়েকটা বেলা। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় এ জায়গা তথাকথিত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শহরের আমি তা ভুলেই গেলাম, ঠান্ডার ভিতরে এমন নদী দেখে। ফলে মন স্থির হল জীবনের শান্তি এলো। হারিয়েই গেলাম পুরোপুরি।

মনের ক্ষততে প্রকৃতি দিল শান্তির প্রলেপ

আমার জীবনের শেষটুকু কাটাব এই রোলেপ।

 

নদীর পাড়ে পাহাড়ি জঙ্গল। আর এই বাংলো বাড়ি – আমাদের হোমস্টে। আরও একটি তৈরি হয়েছে সামান্য দূরে। এখানে চারটি ঘর – তিনটি অতিথিদের, আর একটিতে হোমস্টে মালিক ও তার ফ্যামিলি থাকেন। এই পান্ডব বর্জিত স্বর্গরাজ্যে কাল সন্ধ্যাবেলা বসে মনে হচ্ছিল পাগলা মেজাজটাই রাজা, আমি তো গোলাম। কাল রাতে চারিদিক ছিল নিকষ কালো অন্ধকার। ঐ দূরের পাহাড়ের গায়ে তিন-চারটে টিমটিমে আলো। সামনের বহমান নদীর গগন বিদারী শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছিল। আমাদের সারথী লুকান আর হোমস্টের মালকিন বার কয়েক জানতে চাইলেন এত আওয়াজে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা। ওঁনাদের বোঝাতে পারিনি এই স্থান বই পড়া, বেঁচে থাকার আদর্শ। এখানে যদি সময় কাটানো যায় মাইন্ড একদম রিফ্রেশ হতে বাধ্য। সামনে হালকা ট্রেক করে ছুঁয়ে আসা যায় ছোট্ট দড়ির ব্রিজ। এখানকার মানুষজন নদীর এপাড় ওপাড় করেন। আমার তো অদ্ভুত সুন্দর লাগল স্থানটি।

Related image

আজ সকালে নদীর পাড়ে কিছুটা সময় প্রাতরাশের করতে করতে দেখলাম। তারপর তো বেড়িয়ে পড়লাম।

রাস্তায় রঙ্গোলি-তে সিল্ক রুটের পাস বানানো হল। পথে পড়ল এক পাহাড়ি ঝর্ণা “কিউ খোলা”।

 

পদম চেন

Image result for padamchen sikkim


আবার ঘন্টা দুই গাড়িতে। তারপরেই পাহাড়ের কোলে পদম চেন। পুরো ওয়ালপেপারের মত জায়গা। কিন্তু সিলারী গাঁও, ইয়াকতেন, রোলেপ এর মত স্থানের থেকে এই স্থানটি আলাদা নয়। একই রকম ফিলিং। দুপুরের খাওয়ার পর ঘুরে আসতেই পারেন কাছেই পাহাড়ের উপর এক মনাষ্ট্রী। পাহাড়ের পরতে পরতে যেমন রহস্য, তেমনই পাহাড়ের অলিতে গলিতে লুকিয়ে আছে মনাষ্ট্রী। কেন বৌদ্ধ ধর্ম বা গুম্ফা কেবল পাহাড়েই বেশী প্রসারিত তা আমার তেমন জানা নেই। হয়তো পাহাড়ি মানুষের অনেক কষ্টের জীবন। তাই বৌদ্ধ ধর্মের কৃচ্ছসাধনের সাথে তা মিশে গেছে। সুন্দর পাহাড়, সুন্দর পরিবেশ, নীরবতা, শীতলতা, এই স্থানটিতেও যেন সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

Related image

 

নাথাং ভ্যালি

পদমচেন থেকে এবার গন্তব্য নাথাং ভ্যালী। কিছুটা দূরত্বে জুলুকের বিখ্যাত জিগজ্যাগ রাস্তা পেরিয়ে আমাদের যাত্রা এবার উপরের দিকে। প্রথম থামলাম ১১২০০ ফুট উচ্চতায় থাম্বি ভিউ পয়েন্টে। তারপর নাম না জানা স্থানে থেমেছি প্রকৃতির শোভায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। ফ্রেমের পরে ফ্রেম কেবলই বিস্ময়। রাস্তার সমস্তটাই রাশি রাশি পাহাড়ি ফুল, এদিকে ওদিকে চড়ে বেড়াচ্ছিল ইয়াক আর সাথে ছিল মেঘবালিকা। সীমান্তবর্তী অঞ্চল তাই সর্বত্রই মিলিটারী। অনেক রকমের ট্রেনিং ক্যাম্প, ইতি-উতি ব্যাঙ্কারের ক্যানভাস। ক্রমশ যাত্রাপথে উপরে দেখা গেল “নাথাং ভ্যালী”। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা উল্টানো বাটি/গামলার (অবতল দিক) মত জায়গাটি।

Image result for nathang valley sikkim

যেদিকেই তাকাবেন সবুজ ঘাসে মোড়া উপত্যকা আর ঠিক মাঝখানে কিছু বাড়িঘর, দূর থেকে খেলনার মত লাগছিল। উপর থেকে নাথাং ভ্যালি দেখতে দেখতে পৌঁছলাম পুরনো বাবা মন্দিরে। বাবা হরভজন সিং-এর নামে এই ধর্ম নিরপেক্ষ মন্দির (হিন্দু, মুসলিম, শিখ ও খ্রীষ্ট ধর্মের চিহ্ন সমন্বিত)। কথিত আছে উনি নিরুদ্দেশ হবার পরেও সীমান্তের সর্বত্রই ওঁনার উপস্থিতি অনুভূত হয় আর সমস্যার সমাধানও করে দেন। ওঁনার নামে সমস্ত রকম সরকারি প্রথাই পালিত হয় আজও (যেমন বেতন, ছুটি, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি)। ভ্রমণার্থীদের সুবিধার্থে ছাঙ্গু লেকের কাছাকাছি নতুন একটি বাবা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় পরবর্তীতে। তবে এটাই আদি মন্দির।

Related image

এসবের ভ্রমণ পথ পেরিয়ে সরাসরি নাথাং ভ্যালিতে নামলাম। সেদিনের রাত্রিবাস ওখানে।

এক শেরপা দিদি-এর পরিচালনায় তার অতিথি গৃহে। সবচেয়ে আন্তরিক এবং অতিথি বৎসল আস্তানা এটাই ছিল।  সুস্বাদু খাবার পাহাড়ি ছোঁয়া, অতি উচ্চতার কারণে (১১৭০০ ফুট) খাবার জন্য গরম জল, এমনকি হাত ধোয়ার জন্যেও গরম জলের ব্যবস্থা। সন্ধ্যেবেলা দিদি কফি-পাকোড়া দিয়েই বলে গিয়েছিলেন চা/কফি খেতে ইচ্ছে হলেই যেন দ্বিধা না করি। হাড় হিম করা শীতটা বেশ উপভোগ করার মতো। উপভোগ্য ভ্রমণের সবটুকুই।

এসব সন্ধ্যা কেবলই তোমার কথা বলে

নাথাং ভ্যালি এখানেও তোমার কথায় চলে

রাতে শীতের কামড়ে ঘুমটা জমল না। একটা কম্বল ও একটা লেপ তবু দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল। ভোরবেলায় ভ্যালীটা একবার দেখে এলাম। অপূর্ব। যে বাড়িতে দেরীতে ওঠে তাকেও বলব ভোরের নাথাং ভ্যালিটা একবার দেখবেন।  এখানের ব্রেবফাস্টে মশালাদার নুডলস। ব্যাতিক্রমী রান্নায় ও ঐ ঠান্ডায় বেশ টেস্টি লাগল। বাঙালি ডাল ভাত রুটি লুচি ছেড়ে কটা দিন মোমো নুডলসে মন্দ লাগবে না আপনাদেরও। এর পরে প্রথম দ্রষ্টব্য হাতির শুঁড়ের মত দেখতে “কুপুপ লেক”।

Image result for kupup sikkim

গাড়ি থেকেই দূরের পাহাড়ে বরফও দেখা যাচ্ছে, মাঝে আরও কিছু ভিউ পয়েন্ট ও নাম না জানা ঝিল পেরিয়ে নতুন বাবা মন্দির৷ সেখান থেকে যাত্রা শুরু ছাঙ্গু লেকের দিকে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে চলার পথেই রাস্তার পাশে বরফ। তাই বিরতি শেরথাং-এ৷ বরফে কিঞ্চিত দাপাদাপি এই বয়সে আপনারও করতে ইচ্ছা করবে এবং আর সাথে অবশ্যই সেলফি সেশন। তবে এখানে কুচো বরফই বেশি পাবেন।

Image result for thangu sikkim

ছাঙ্গু লেক

বরফ শীতল আনন্দ করে এসে পৌঁছাবেন ছাঙ্গু লেকে। ছাঙ্গু লেকের (সঙো লেক) নিজস্ব রূপ রস। তবে গ্যাংটক থেকে প্রচুর পর্যটক এখানে আসেন।

সমস্যা সেখানেই। অনেকটা দূষিত হচ্ছে। তারপরে ভীড়। তবু মানুষ তো আসবেই। লেকের এদিক ওদিক ঘুরে ফটো তো তুলতেই হবে। আনন্দ করতে তো আসা। অনেকেই ইয়াকের পিঠে চেপে ফোটোসেশন করলেন। সামনেই মিলিটারি বেস ক্যাম্প। তাই আমাদের দেশের জওয়ানরা এখানে চিরকালীন।

জুলুক

Image result for silk route sikkim

বরফের খেলা পেরিয়ে চার ঘন্টার ড্রাইভ। চললাম জুলুক। পুরনো রাস্তা দিয়ে ফিরে নাথাং ভ্যালী পেরিয়ে পদমচেন এর ৯কিমি. আগে জুলুক।  এই জুলুকের প্রধান আকর্ষণ জিগজ্যাগ রোড। পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল পাকদন্ডী পথে বমি ভাব এলেও আমার তো পাহাড়ি গান হেব্বি লাগছিল। সিকিমের গান সত্যই সুন্দর। হিন্দি গানকে টেক্কা দেয়। তবে আমার কানে বার বার তালা লেগে যাচ্ছিল। পাহাড়ের কোলে হোমস্টে টি সুন্দর একটি লোকেশনে। যদিও প্রধান সড়ক থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। সিড়ি ও পাথরের চড়াই রাস্তা পেরিয়ে বয়স্ক ও বাচ্চাদের জন্য সমস্যা হতেই পারে। যদিও নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে এটুকু কষ্ট করা যেতেই পারে। সিলারী গাঁও বা ইয়াকতেন এর মতই পাহাড়ি গ্রাম জুলুক। কিন্তু সৌন্দয্যের বিচারে বাকিদের টেক্কা দিয়ে দেবেই।

সিল্ক রুটের জুলুক বলে দেয় ঘরের ফেরার গান

জিগজ্যাগ পথেই ফিরতে হবে, মনটা যে আনচান

 

শিলিগুড়ি

সকালে ব্রেকফাস্ট করে সুন্দর প্রকৃতির জুলুককে টাটা করতে করতে মাঝরাস্তা থেকে তিস্তাকে সঙ্গী করে পাহাড় থেকে তরতরিয়ে নেমে আসা শহরে।

শিলিগুড়ি পাঁচ ঘণ্টার পথ। নদীর এই মনকেমনিয়া স্রোত মনে করিয়ে দেয় আবার সেই শহর, টার্গেট, কাজ। ভীড়, পড়া, প্রেম, অপ্রেম, ঝগড়া, মেল, চ্যাট। সিল্করুটের পরিব্রাজক কতটা হতে পারলাম জানি না, তবে ফিরব কথা দিলাম। প্রকৃতি তোমার জন্যই আবার মানুষ হব এই কথাটা দিলাম। সত্যিই বলছি পাহাড়ের শাসনে আমি আমার মানুষের মতো মানুষ হতে শিখলাম। প্রকৃতি পারে এভাবে শিখিয়ে দিতে মানুষ সংগ্রামের লড়াইয়ে বেঁচে থাকার হাসিপথ। প্রকৃতির ঐ সিল্করুট বেঁচে থাকর শপথ।