শ্রীপর্ণা~ সারা বছর তো অনেক হল. এবার কিন্তু সময় আমাদের পুরোনো মেনুতে ফেরার৷ মানে জমিয়ে বাঙালি খাবার খাওয়ার৷ পাতে সাদা সরু চালের গরম ভাত, ঘি আর পঞ্চ ব্যাঞ্জন৷ তা না হলে কি আর নববর্ষ পালন করলেন৷ নববর্ষ মানে হই চই, হুল্লোড়, মজা, আড্ডা, নতুন পোশাক আর অবশ্যই জমিয়ে খাওয়াদাওয়া। যে কোনও উৎসবেই খাওয়াদাওয়া একটা বড় ফ্যাক্টর, অন্তত বাঙালিদের জন্য। তাই আজ আর কন্টিনেন্টাল বা চাইনিজ নয়৷ খাওয়াদাওয়ায় থাক খাঁটি বাঙালিয়ানার ছোঁয়া।
ব্রেকফাস্ট নয়, আজ খান জলখাবার৷ পাতে পড়ুক লুচি, সাদা আলুর তরকারি এবং ল্যাংচা বা পছন্দের হরেক মিষ্টি৷ সে তো না হয় হল৷ দুপুরে আর রাতের খাবারের মেনু তো ঠিক করতে হবে৷ বর্ষবরণের মেনুতে কী রাখবেন বুঝতে পারছেন না? দাঁড়ান, একটা হদিশ দিই আপনাদের৷ বেছে নিন পছন্দের রান্না৷ মেনুতে রাখতে পারেন
স্টাফড করোলা
করোলা মানেই তেঁতো তা না। যদি বিশ্বাস না হয়, সাদা ভাতের সঙ্গে এদিন রাখুন স্টাফড করোলা।
কলাপাতায় মুড়ে মাছের কাবাব
পাতুরী আমরা সবাই ভালবাসি। কিন্তু পাতুরীর বদলে এদিন বরং বেছে নিন কলাপাতায় মুড়ে মাছের কাবাব।
নারকেল চিংড়ির বাটি চচ্চড়ি
নারকেল চিংড়ির বাটি চচ্চড়ি রান্নাটি বহু পুরনো। এখন এভাবে রান্নার চলন আর নেই। তাই বাংলার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে দেখতে পারেন নববর্ষেই।
ডাব চিংড়ি
আহা ডাব চিংড়ি কিন্তু মেনুতে থাকা মাস্ট। সাদা ভাত দিয়েই ভাল যাবে এটা।
জাফরানি পোলাও
সাদা ভাতের পাশাপাশি রাখুন জাফরানি পোলাও।
ডিম কোর্মা
আপনি যদি প্রচণ্ড ডিম ভক্ত হোন, তাহলে মেনুতে রাখতে পারেন ডিম কোর্মা।
আচারি পনির
আপনি নিরামিশাষী হলে বা পনির খেতে ভালবাসলে রাখতে পারেন আচারি পনির।
ধনিয়া পোস্ত চিকেন
বাঙালি মানেই পোস্ত, পোস্ত মানেই বাঙালি। আর সেই পোস্ত দিয়েই হয়ে যাক ধনিয়া পোস্ত চিকেন।
বিটের হালুয়া
গাজরের হালুয়ার মতো বিটের হালুয়া এত জনপ্রিয় না হলেও, বিটের হালুয়া আপনাকে নিরাশ করবে না তা জোর দিয়ে বলা যেতেই পারে। তাই নবর্ষের মেনুতে থাক বিট হালুয়া।
এছাড়াও নববর্ষের খাবারের তালিকায় যদি একটু গ্রামীণ ছোঁয়া যোগ করতে চান, তাহলে থাকুক নানা রকম গ্রামীণ আয়োজনে ভরসা৷ যার ভেতর থাকছে, বিন্নি খই, চিনি সাঁজ, বাতাসা, ছাতু, মিষ্টি ইত্যাদি। যদিও ইলিশ ছাড়া বৈশাখ ঠিক জমে না কিন্তু সাধ আর সাধ্য দুটো তো আর এক নয়। কাজেই এবারের নববর্ষ কাটুক একটু ভিন্ন স্বাদে। আজকাল সবই তো অনলাইন অর্ডার করলেই পাওয়া যায় কিন্তু শেষ কবে মেলায় গিয়ে নানান রকম আচার, মুড়ি-মুড়কির নাড়ু আর বিন্নি খৈ কেনা হয় মনে পড়ে? দিন দিন যেন হারিয়েই যাচ্ছে গ্রামের ছোঁয়া। তাই এবারের নববর্ষ কাটুক একটু ভিন্ন আয়োজনে।
তবে সারা সপ্তাহের ক্লান্তির পর এত আয়োজনের ধকল নিতে মন চায় না? তাহলে দ্বারস্থ হন বিভিন্ন রেস্তোঁরার৷ আজকাল বিভিন্ন রেস্তোঁরায় আয়োজন থাকে বৈশাখি খাবারের৷ বাঙালি হয়ে পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাবেন না, তা কী করে হয়! একদিনের বাঙালি হওয়ার জন্য পান্তারও ব্যবস্থা করে এই সব রেস্তোরা গুলি৷ শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই সব জায়গায় ঢুঁ মারা যায় বইকি৷ বৈশাখ এলে এখন যে খাবারের স্ট্যাটাস বেড়ে যায় সেটি হচ্ছে পান্তা-ভাত। বছরের বাকি সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে দিন কাটালেও পহেলা বৈশাখের সকাল থেকে ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার পাতে সগৌরবে উপস্থিত এই পদ।
সাহিত্যিক অজিতকুমার গুহের বর্ণনায় প্রায় একশ বছর আগে নববর্ষের বিভিন্ন মুখরোচক খাবার-দাবার এবং মেলার চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়।
তিনি লিখেছেন, ‘চৈত্রের সংক্রান্তি আসার কয়েক দিন আগে থেকেই আমাদের ঢেঁকিঘরটা মুখর হয়ে উঠত। নববর্ষের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে নাড়ু, মোয়া, ছানার মুড়কি ও সরভাজা দিতে হবে; তারই আয়োজন চলতে থাকতো।…মেলায় আর এক দিকে ডালা, কুলো, বেতের ও বাঁশের তৈরি নানা রকম সাজি, মাছধরার চাঁই, হাল ইত্যাদিও আছে। ওই দোকানগুলো পেরিয়ে একটু ডান দিকে গেলেই দেখা যেতো নানারূপ ফল ও তেলে ভাজার দোকান। বিন্নিধানের খৈ পাওয়া যেত এই মেলায়। আমার ঠাকুমা চাকরদের নিয়ে মেলায় যেতেন। মাঠের ধারে একটি ঘর থেকে তিনি মেলা দেখতেন। তারপর চাকরদের দিয়ে চিত্রিত করা হাঁড়িতে বিন্নিধানের খৈ, গুড়ের বাতাসা ও জিলাপি কিনে আনতেন। বাড়িতে এসে সকলের হাতে মুঠো করে বিন্নিধানের খৈ, গুড়ের বাতাসা আর জিলাপি দিতেন। আমাদের তা দিয়ে মহা আনন্দ উৎসব সমাপ্ত হত।’
সেই ছবি আজ বইয়ের পাতায়৷ তবু বাঙালি খুঁজে ফেরে হারানো পরশ পাথর৷ মা দিদিমার কাছ থেকে শেখা কিছু রান্না নতুন মোড়কে ফিরে আসে আজকের বং জেনারেশনের পাতে৷ বৈশাখি উদযাপনে বেঁচে থাকে সাধের বাঙালিয়ানা৷