আমার আপনার সবার রান্নাঘরেই প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু খাঁটি বাঙালি খাবার রান্না হয় । কি অবাক হচ্ছেন তো?ভাবছেন যে , সাধারণ ডাল, আলু পোস্ত, লাউয়ের ঘন্ট,,কচু বাটা, বাদাম দিয়ে করা লাল শাক, জিরে বাটা দিয়ে মাছের ঝোল, কম তেলঝাল মশলা দিয়ে রান্না করা মুর্গীর মাংস , আর রবিবার একটু কষা কষা করে বড় বড় আলু দিয়ে পাঁঠার মাংস, এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার ? কিন্তু জানেন কি? সারাকলকাতা শহর জুড়ে এই খাঁটি বাঙালি খাবারের ওপর নির্ভর করেই ছোট বড় কতরেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, এবং সেখানে প্রতিদিন অনেক অনেক মানুষ এই রোজ এর রান্নাই উপভোগ করে খেতে আসে |
এবারে ধরা যাক, কিছু সাধারণ পরিস্থিতি| সপ্তাহের শেষে সব বন্ধুরা এক জায়গায় হয়েছেন একটু আড্ডা, একটু হাসি ঠাট্টা, আর তার সাথে পেট পুজোর পরিকল্পনা নিয়ে। আবার ধরুন, আপনার বাড়িতে একটি ছোট খাটো উৎসবে একত্রিত হয়েছেন কিছু আত্মীয় পরিজন| একদিকে তো আপনার একটু ও রান্না করতে ইচ্ছা করছে না আবার অন্য দিকে পকেটের কথাটাও ভাবছেন । অথচ অনেকেই চাইছেন ফুলকো লুচি, ছোলার ডাল আর ঝাল ঝাল করে করা আলুর দম| আবার কেউ বা চাইছেন কাচঁকি মাছের ঝাল দিয়ে গরম গরম সুগন্ধি সাদা চালের ভাত| নিশ্চিন্তে থাকুন| ফুল কোর্স মেনুর মতো, প্রথম পাতে শুক্তো থেকে শুরু করে, শেষ পাতে চাটনি এবং পায়েস এমনকি মিষ্টি দই পর্যন্ত যত্ন করে সাজিয়ে পরিবেশন করবে এই সব রেস্তোরাগুলি| তাহলে আর দেরি কেন? চোখ রাখুন আমাদের পাতায় আর জেনে নিন কলকাতার কিছু বিখ্যাত বাঙালি খাবারের রেস্তোরার হদিশ।
১. ৬ বালিগঞ্জ প্লেস : এই রেস্তোরাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালে। এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল খাঁটি এবং অভিজাত বাঙ্গালি খাবারের বিশেষত্ব ভোজনপ্রিয় বাঙালির কাছে তুলে ধরা| মূল রেস্তোরাঁটি বালিগঞ্জের একটি সাদা শতাব্দী পুরানো কিন্তু নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা বাংলো বাড়িতে অবস্থিত। এখানকার রন্ধন প্রণালী অত্যন্ত উচ্চমানের। এখানে সমস্ত রকমের বাঙালি খাবারের সাথে সাথে ঠাকুর বাড়ির কিছু
বিশেষ রান্নাও চেখে দেখার পুরোপুরি সুযোগ পাবেন | তবে একযোগে দুপুর এবং রাতের খাবারের (Buffet Lunch and Donner) ব্যবস্থাও রয়েছে।
যোগাযোগের ঠিকানা: ৬ বালিগঞ্জ প্লেস , বালিগঞ্জ, এবং, ডিডি ৩১ এ
সেক্টর ১ , সল্ট লেক , কলকাতা|
অবশ্যই খাবেন: সর্ষে পোস্ত দিয়ে করা মশলাদার পাবদা মাছের ঝাল।
খরচ: মোটামুটি দু-জনের জন্য পড়বে ১০০০-১২০০ টাকা
২. ওহ! ক্যালকাটা : পকেটে যদি একটু বেশি জোর থাকে তাহলে সোজা চলে আসুন ওহ!ক্যালকাটায়। এই রেস্তোরার অনেকগুলি শাখা সারা দেশ জুড়ে রয়েছে| এখানকার খাবারে বৈশিষ্ট্য হলো বাঙালির ঐতিহ্যগত খাবারগুলোকে নতুন ভাবে নতুন রূপে আপনার সামনে পরিবেশন করা| খাবার জায়গার পরিবেশটিও ভীষণ সুন্দর এটি একটি পুরস্কার বিজয়ী রেস্তোরাঁ
ঠিকানা: ফোরাম মল, ১০/৩ এলগিন রড, লাল রাজপত রায় সারণি, কলকাতা এবং
সিলভার আর্কেড, যে বি এস হালডেন এভিনিউ, কলকাতা।
অবশ্যই খাবেন: ভাপা ইলিশ এবং স্মোকড ভেটকি।
খরচ: মোটামুটি দু-জনের জন্য পড়বে ২০০০ টাকার মতো।
৩. আহেলী- পিয়ারলেস ইন: আদর্শ বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ যেখানে দেশি এবং বিদেশী সব ধরণের ভোজনবিলাসীরাই হাজির হয়| এখানকার বৈশিষ্ট্য হলো, আগেকার দিনের ‘জমিদার বাড়ির রান্না’এবং যা পরিবেশন করে পুরোপুরি বাঙালি পোশাকে সজ্জিত পরিচারক এবং পরিচারিকারা|
অবশ্যই খাবেন: নারকেলের দুধে রান্না করা চিংড়ি মাছের মালাইকারি এবং
রুই মাছের পাটিসাপ্টা|
খরচ:দু-জনের জন্য প্রায় ২০০০ টাকা|
ঠিকানা: ১২ জওহরলাল নেহেরু রোড, এসপ্ল্যানেড , কলকাতা
৪. ভজহরি মান্না : মনে পরে প্রখ্যাত গায়ক মান্না দের কণ্ঠে সেই গান ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’, সালটা ১৯৭০ হলেও আজও যেন কালজয়ী, ঠিক ধরেছেন আমি কথা বলছি বাঙালি খাবারের এক অন্যতম সেরা রেস্তোরাঁ ভজহরি মান্নার | বর্তমানে এই রেস্তোরার অনেকগুলি শাখা কলকাতা শহর জুড়ে রয়েছে|
অবশ্যই খাবেন: নারকেলের শাঁস , দুধ ও সর্ষে দিয়ে করা ডাব চিংড়ি এবং কষা মাংস।
খরচ:দু-জনের জন্য প্রায় ৬০০ টাকা।
ঠিকানা: ১৮/১এ , হিন্দুস্থান রোড, গড়িয়াহাট , কলকাতা| এছাড়াও রয়েছে হাজরা, কালিয়া রোড, সল্ট লেক সেক্টর ১, ষ্টার থিয়েটার (হাতিবাগান), কসবা-রুবি এবং স্প্লানেডে।
৫. কস্তুরী: ১৯৯৪ সালে গড়ে ওঠে এই রেস্তোরাঁটি | কলকাতার বুকে সর্বপ্রথম ঢাকাই বাংলাদেশী খাবারের রন্ধন প্রণালীর প্রচলন ঘটে এই রেস্তোরার হাত ধরেই| এরও অনেকগুলি শাখা আছে
অবশ্যই খাবেন: কচু পাতায় মোড়ানো ভাঁপা চিংড়ি|
খরচ: দু-জনের জন্য প্রায় ৬০০ টাকা|
ঠিকানা: ৭ এ , মুস্তাক আহমেদ স্ট্রিট , নিউ মার্কেট কলকাতা ,১ ১ /এ , ডোভার লেন, হিন্দুস্তান রোড, কলকাতা| এছাড়া, যাদবপুর, বালিগঞ্জ এবং নাগেরবাজারেও শাখা রয়েছে|
৬. কষে কষা : নামটা শুনেই বুঝতে পারছেন তো ? একদম, কষা কষা পাঁঠার মাংসের বিভিন্ন রন্ধন প্রণালী নিয়ে হাজির এই রেস্তোরাঁটি বর্তমানে বিশেষ জনপ্রিয়। এই রেস্তোরার অনেকগুলি শাখা থাকলেও আসন সংখ্যা কিন্তু সীমিত।
অবশ্যই খাবেন: মাটন কষা ভাত বা রুটির সঙ্গে।
খরচ:দু-জনের জন্য প্রায় ৬৫০ টাকা।
ঠিকানা: ৬২ , বালিগঞ্জ গার্ডেন , গোলপার্ক , কলকাতা| এছাড়াও রয়েছে,
পার্ক স্ট্রিট , সল্ট লেক সেক্টর ৩, বেহালা, রাজারহাট, যাদবপুর, হাতিবাগান,
গড়িয়া এবং ডালহৌসি অঞ্চলে|
৭. সপ্তপদী: ১৯৬১ সালে নির্মিত সুচিত্রা সেন এবং উত্তম কুমার অভিনীত সর্বযুগের সেরা রোমান্টিক বাংলা সিনেমার নাম অনুসারে গড়ে উঠেছে এই রেস্তোরাঁটি| এর অন্দর সজ্জায় দেখা যায় এই সিনেমার বিভিন্ন ছবি, পুরানো দিনের অভিনেতা, অভিনেত্রীদের ছবি| শুধু তাই নয় শুনতে পাবেন পুরানো দিনের অনেক সুন্দর সুন্দর রোমান্টিক গান| এখানকার খাবারে আপনি পাবেন চিরাচরিত এবং নতুনত্বের মেলবন্ধন
অবশ্যই খাবেন: কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাংসের ঝোল (উত্তম কুমারের প্রিয়)
খরচ: দু-জনের জন্য প্রায় ১০০০ টাকা।
ঠিকানা: ৪৯ বি , পূর্ণ দাস রোড, হিন্দুস্থান পার্ক, কলকাতা এবং জি ৪০ এ বাঘা যতীন, গাঙ্গুলি বাগান পোস্ট অফিস এর কাছে, কলকাতা|
৮. বোহেমিয়ান: স্বাদবদলের জন্য চলে আস্তে পারেন বোহেমিয়ান| এখানে পাবেন কনটেম্পোরারি বাঙ্গালী ফুসিং ফুড | দেশি খাবারের সাথে সাথে বিদেশী খাবার ও চেখে দেখতে পারেন| এছাড়াও পাবেন বিভিন্ন রকমের নিরামিষ খাবারের সম্ভার।
অবশ্যই খাবেন: রয়্যাল বেঙ্গল রোস্ট মটন ।
খরচ: দু-জনের জন্য প্রায় ১৮০০ টাকা।
ঠিকানা: ৩২/৪ ওল্ড বালিগঞ্জ ১স্ট লেন কলকাতা|
৯. লোকাহার : বাঙালি খাবারের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে এই রেস্তোরাঁটি গড়ে ওঠে ২০১৫ সালে সাউথ সিটি মল এর কাছে| এই স্বতন্ত্র রেস্তোরাঁটি ক্রমাগত খাবারের গুণমান বজায় রাখার জন্য বিখ্যাত| রেস্তোরার মালিকেরা তাদের বাড়ির নিচের অংশ
জুড়ে তৈরি করেছেন এই রেস্তোরাঁটি| এর আসন সংখ্যা খুব সীমিত , ২৫ জনের মতো। সাধ্যের মধ্যে লোভনীয় খাবারের সাথে সাথে গ্রাম্য জীবনের একটি পূর্ণ ছবি তুলে ধরা হয়েছে এই রেস্তোরায়| বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা হাতের কাজের বিপুল
সম্ভার ও পাবেন এখানে যা আপনি কিনতেও পারবেন।
অবশ্যই খাবেন: পোস্ত বড়া, মোচা চিংড়ি, ধোঁকার ডালনা, মাটন ডাক
বাংলো, চন্দনা ক্ষীর|
খরচ: দু-জনের জন্য প্রায় ৪০০ টাকা|
ঠিকানা: প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, ৫৩৩ যোধপুর পার্ক, কলকাতা|
এছাড়াও আছে, ষোলোআনা বাঙালি ( প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, ৫০০ টাকা প্রতি দুজনে), পদ্মাপাড়ের রান্নাঘর (গড়িয়াহাট, ৫০০ টাকা প্রতি দুজনে), ঠাকরুন (হিন্দুস্থান পার্ক, ৭০০ টাকা প্রতি দুজনে), ভোজ কোম্পানি (নিউ মার্কেট অঞ্চল, ৬০০ টাকা প্রতি দুজনে, সাড়ে চুয়াত্তর (সাদার্ন এভিনিউ , ৪৫০ টাকা প্রতি দুজনে)
সাধারণ মানুষ এখন শুধু নিজেদের ঘরের রান্না খেয়েই তৃপ্ত হতে পারছেন না। তাদের চাই সাধ্যের মধ্যে কিছু স্বাদ বদল| একে রুচির বদল ও বলতে পারেন। আর বলতে পারেন চিরাচরিত ধ্যান ধারণা থেকে একটুখানি সরে গিয়ে নতুন কিছুকে আপন করে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা।