লেখিকা পরিচিতি ~ সংযুক্তা সেন, প্রখ্যাত আইনজীবী বিধাননগর মহকুমা আদালত ( ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ )
মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ
তৃতীয় পর্ব
এবারে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল মহিলাদের বিরুদ্ধে যে সব হিংসামুলক অপরাধগুলি হয়ে থাকে তা নিয়ে।
পারিবারিক হিংসা
আজকাল পারিবারিক হিংসা এমন একটা অপরাধ যেটা প্রায় অনেক সংসারেই ঘটে থাকে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার মহিলাদের আইনগত অধিকার ও প্রতিরক্ষা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত রক্ষামূলক একটি আইন প্রনয়ন করা হয়। আইনটি হল পারিবারিক নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে সুরক্ষা আইন ২০০৫। এই আইন জম্মু ও কাশ্মীর ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষে প্রযোজ্য হবে। শুধুমাত্র মহিলদের জন্য এই আইনটি প্রযোজ্য। শুধু বিবাহিত মহিলারাই নয় এই আইনে যে মহিলারা লিভ ইন সম্পর্কে আছেন বা বৈবাহিক সম্পর্কের মত একটি সম্পর্ক রেখেছেন, তারাও তাদের পরিবারের ভিতর যে কোন হিংসার বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করতে পারেন। এই আইনের দ্বারা শারীরিক, মানসিক অত্যাচার ছাড়াও মৌখিক, আর্থিক ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধেও মামলা করতে পারেন। এই আইনের অধিক্ষেত্রকে কিছুটা বিস্তার করা হয়েছে যাতে মহিলারা নিজের বাসস্থান বা তার পিতার বাড়ি ছাড়াও সাময়িক বাসস্থান, কর্মক্ষেত্রর ঠিকানা থেকেও এই আইনের অধীনে মামলা দাখিল করতে পারেন। মামলা দাখিল করার জন্য মহিলারা নিজেরাই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বা রক্ষাকারী আধিকারিকের কাছে গিয়ে মামলা দাখিল করতে পারেন। এই আইনে মহিলারা সুরক্ষার আদেশ, ভরণ পোষণের জন্য টাকা পয়সার ও ক্ষতিপূরণের আদেশ, বাসস্থানের ও বাচ্চার হেফাজতের আদেশও পেতে পারেন। এছাড়াও মহিলারা পরিবার উপদেষ্টাদের সাহায্য পেতে পারেন।
বধূ নির্যাতন
কোন মহিলা বিবাহের পর তার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়দের দ্বারা যদি পণের জন্য শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হন তাহলে ভারতীয় দণ্ড সংহিতার ৪৯৮এ ধারায় অভিযোগ করতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বিবাহের পর স্বামী ও শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়রা বিভিন্ন দাবী মেটানোর জন্য বিবাহিত মহিলাটির ওপরে অত্যাচার করে, এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। সেই মহিলাটি থানায় পুলিশের কাছে তার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়দের নামে অভিযোগ আনতে পারেন। দোষ প্রামাণ হলে ভারতীয় দণ্ড সংহিতার ৪৯৮এ ধারায় ৩ বছরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানা হতে পারে।
বাল্য বিবাহ
দীর্ঘদিন ধরে বাল্য বিবাহ ভারতের একটি সমস্যা। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি, প্রাথাগত রীতিনীতি, ধর্মীয় কুসংস্কার ও অশিক্ষা জনিত কারণে বাল্য বিবাহ আজও প্রচলিত আছে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১৫ লাখের বেশি মেয়েদের ১৫ বছরের নীচে বিয়ে হয়েছে। UNICEF ১৮ বছরের নীচে বিয়েকে মান্যতা দেয় না, বরং সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করা হয়। এই ধারনের বিয়ে তে কিছু ক্ষতিকর দিক আছে যেমন খুব কম বয়সে শিশুকে তার পরিবার ও বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তার ফলে সেই শিশুর মানসিক বিকাশ ঠিক করে হতে পারে না, অল্প বয়সে যৌন শোষণের শিকার হতে হয়। কম বয়সে মাতৃত্বের কারনে শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। ১৯২৯ সালে ভারতে প্রথম বাল্য বিবাহ নিরধক আইন প্রণয়ন হয় পরবর্তী কালে ২০০৬ সালে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন আনা হয়। এই আইন অনুযায়ী ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নীচে বিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ যদি কোন ১৮ বছরের নীচে বয়সের মেয়েকে বিবাহ করে তবে সেটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। দোষ প্রমাণ হলে ২ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড অথবা জরিমানা যা ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে অথবা উভয় হতে পারে। যদি কোন ব্যক্তি কোন শিশু বিবাহের নির্দেশ দেয় বা সঞ্চালন করেন তাহলে সেটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোন ব্যাক্তি, অভিভাবাক, পিতা-মাতা, বা কোন সংগঠনের সদস্য যদি কোন বাল্য বিবাহের অনুষ্ঠানের প্রাচার, অনুমোদন করে থাকে বা অংশগ্রহন করে থাকে তাহলে দোষ প্রমাণ হলে ২ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড অথবা জরিমানা যা ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে অথবা উভয় হতে পারে।
অ্যাসিড নিক্ষেপ
আজকাল খবরে প্রায়ই দেখা যায় বা শোনা যায়, মহিলাদের ওপরে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনার কথা। যদি কেউ কারুর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করে যার ফলে তার শরীরে কোন প্রকার স্থায়ী বা আংশিক ক্ষতি বা বিকার ঘটে, পুরে যায়, জ্বলে যায়, বিকৃত হয়ে যায় তাহলে সেটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। দোষ প্রমাণ হলে ভারতীয় দণ্ড সংহিতার ৩২৬এ ধারায় সশ্রম কারাদণ্ড যা ১০ বছরের কম নয় ও যেটা আজীবন কারাবাস পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে ও তার সঙ্গে আর্থিক জরিমানা। শুধু যে অ্যাসিড নিক্ষেপ করেছে সে নয় যদি কেউ তাকে সাহায্য করে থাকে তারও একই সাজা হবে।
অপহরণ
কোন ব্যক্তি যদি কোন নাবা্লক বা নাবালিকাকে অপহরণ করে তাকে দিয়ে ভিক্ষা করানোর অভিপ্রায় তবে ভারতীয় দণ্ড সংহিতা ১৮৬০ এর ৩৬৩এ ধারায় শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ১০ বছর অবধি কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। কোন ব্যক্তি যদি কোন নারীকে বল পূর্বক বা ভয় দেখিয়ে অপহরণ করে তাকে কলুষিত করার অভিপ্রায় তবে ভারতীয় দণ্ড সংহিতা ১৮৬০ এর ৩৬৬ ধারায় শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা হবে। কোন ব্যক্তি যদি ১৮ বছর বয়সের নীচে কোন নারীকে নীতি বিরুধ্য উদ্দেশ্য সাধনার্থে, ভয় দেখিয়ে বা কোন পদ্ধতিদ্বারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরিত করে ও কোন পুরুষের সাথে অবৈধ যৌন সহবাস করতে বাধ্য বা প্রলুব্ধ করে তখন ভারতীয় দণ্ড সংহিতা ১৮৬০ এর ৩৬৬এ ধারায় শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ১০ বছরেরে কারাদণ্ড ও জরিমানা হবে।
গর্ভবতী কোন স্ত্রী বা কোন মহিলার সম্মতি না নিয়ে তার গর্ভপাত করানো
যদি কেউ কোন গর্ভবতী কোন স্ত্রী বা কোন মহিলার সম্মতি না নিয়ে গর্ভপাত করায় তাহলে সেটা ভারতীয় দণ্ড সংহিতা ১৮৬০ এর ৩১৩ ধারায় শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে আজীবন কারাবাস বা ১০ বছরেরে কারাদণ্ড ও জরিমানা হবে।
সংযুক্তা সেন
আইনজীবী