ভূতের শহর – কলকাতা
বাঙালির চাই আড্ডা। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। দাদু, ঠাকুরদা পেলেই আমরা বসতাম গল্প শুনতে। তখন ভাগ্যিস এই ফেসবুক নামক বস্তুটি ছিল না। কত গল্পই জমে যেত। সাথে থাকত চায়ের সাথে চপ মুড়ি। আষাঢ়ের গল্পরা আষাঢ়ে দিনেই জমে যেত। মনে পড়ে স্কুলে আমার বন্ধু বুধা-র কথা। এতো সুন্দর জমিয়ে অফ পিরিয়েডে গল্প বলত, সেই ডিটেকটিভ থেকে শুরু করে ভূতের জমে যেত সে সব দিন। আজ এমন এক বারিষের দিনে একটু ভূতের গপ্প হোক। জানি অনেকেই রে রে করে উঠবেন। বলবেন ভূত বলে কিছু হয় না, আরে বলছি তো একটু জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার চপ মুড়ি নিয়ে বসলেই সিরিয়ালের প্যাঁচ প্যাঁচানি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবেন।
ভূত মানেই গায়ের মধ্যে কেমন করা ব্যাপার। মনে হয় শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা নেমে গেল, ঠিক অঙ্ক পরীক্ষার আগের মতো অবস্থা, সেই গা-ছমছমে কলকাতা কিন্তু আজও রয়েছে এই শহরে। একটু খুঁজে নিতে হবে। এখন তো শহরে ইভেন্ট হয় এই ভূত দেখা নিয়ে। অনেকেই ভূত দেখে বিষয়টা ইঞ্জয় করতে চায়। পুরো থ্রিলিং নাইট। তবে এখানে পয়সা খরচ করতে হবে। শুধু চাই অনেক শেয়ার করুন। আসুন সেই কথাই একটু জেনে নেওয়া যাক। কলকাতার সব ভূতেরা, তিলোত্তমার অদ্ভূতেরা…
বেলভেডিয়ার হাউজ়-কে আমরা ন্যাশনাল লাইব্রেরি নামে এখন চিনি। এই বাড়িটির পশ্চিম অংশে প্রায় আড়াইশো বছর আগে দু’জন ব্রিটিশ মুখোমুখি লড়াইয়ে নেমেছিলেন। স্বনামধন্য ওয়ারেন হেস্টিংস ও ফিলিপ ফ্রান্সিস। আলিপুর লেনের রেড গার্ডেন হাউজ়ে সুন্দরী মিসেস গ্র্যান্ড থাকতেন। তিনি অপরূপা সুন্দরী ছিলেন। তাঁর স্বামী ফ্রান্সি গ্র্যান্ড যখন বাড়িতে থাকতেন না সব দেখেশুনে হাজির হতেন কাউন্সিলার ফ্রান্সিস। হেস্টিংসও যেতেন সেই বাড়িতে। তবে লাটসাহেব ছিলেন তো তাই একটু নিয়ম মাফিক যেতেন। অন্যদিকে ফ্রান্সিসের সেই অসুবিধে কখনই ছিল না। মিসেস গ্র্যান্ডের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন দু’জনই। এক্ ফুল দো মালি। বিষয়টা হল শ্রীমতী যে কার দিকে রয়েছেন তা বোঝাই যেত না! তাই একদিন শ্রীমতীকে পাওয়ার অধিকার নিয়ে গুলির লড়াই হল। ফ্রান্সিস সাহেব হার স্বীকার করলেন। রক্তাক্ত ও আহত ফ্রান্সিসকে পালকি করে শহরে পাঠানোর চেষ্টা হয়েছিল যদিও তখন আদি গঙ্গায় বান এসেছিল তাই সে যাত্রায় আর পার হতে পারলেন না পালকি নিয়ে। পথেই মারা গেলেন ফ্রান্সিস। এখনও হুন হুনা করতে করতে পালকি নিয়ে সেই আহত ও রক্তাক্ত ফ্রান্সিসকে যেতে দেখা যায়!
ন্যাশনাল লাইব্রেরির কাছেই আলিপুরে জজ কোর্টে আমাদের দরকারে অদরকারে যেতে হয়। অনেকে কোর্টে না গেলেও পাশ দিয়ে গেছেন। সেই জজ কোর্টের পাশেই রয়েছে হেস্টিংস হাউজ়। হাউজ়-এর এখন প্রায় সাড়ে তিনশো বছর বয়স। এই বাড়িতেই রয়েছে হেস্টিংসের ভূত। আরে এই লর্ড হেস্টিংস আমাদের নন্দকুমারকে ফাঁসির সাজা দিয়েছিলেন। ইতিহাসের কড়ি-বড়গাতে শোনা যায় হেস্টিংস জাহাজ করে ব্রিটেনে গেলেও তার এক কালো বাক্স এখানেই রয়ে গেছে। সেটার খোঁজেই আসেন। তবে অশরীরী হয়ে আসে। সেই কালো বাক্সেই রয়েছে গোপন নথি আর রহস্যময় ছবি। অনেকেই নাকি এই সাহেব ভূত দেখেছেন। ঘোড়ার গাড়িতে চেপে আসেন বলেই জানি। এই বাড়িতেই পিয়ানো ছিল, সেটাও নাকি মেমসাহেব বাজাতেন। ও বাব্বা এতো দেখি মেম ভূত। সুরের সেই মূর্ছনা অনেকেই শুনেছেন গভীর রাতে। আলিপুরে জেলের বন্দীরাও সেই ডু-রে-মি টিউন শুনেছেন। বৃষ্টি রাতে হবে নাকি সেই অ্যাডভেঞ্চার।
বিশ্বাস করুন বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাতে হবে না আর। তা বিক্রম বেতাল দেখুক। তবে আপনারা ভূতের হাইকোর্ট খুব ভাল করেই দেখে আসতে পারেন। যে কোনও দিন রাতেই নাকি সাজগোজ করে নারী মূর্তির হেঁটে চলে যায়। বৃষ্টির রাতে বিষয়টা বেশ মনোজ্ঞ। হাইকোর্টে কর্মরত অনেকেই নাকি দেখেছেন তাকে! চলুন ঘুরেই আসি। এছাড়াও এখানে এক বিদ্রোহী কবির ভূতও রয়েছে। কবি নাকি ঘোরাঘুরি করেন। তিনি কুঁজোর জল ঢেলে খান। আওয়াজ পাওয়া যায়। যদিও দিনে অনেক ইঁদুর দেখেছি আমি নিজেই, তবে রাতে গিয়ে কবি তাপিস যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তার সাথে গল্পটা করা হয়নি। জানা যায় তিনি ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাই ব্রিটিশরা তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে ছিলেন। তারই ভূত নাকি হাইকোর্টে আপনার সাথে সেলফি তোলার জন্যই অপেক্ষা করছে।
আর আমি না বললেও মিডিয়ার দৌলতে সকলেই জানেন কলকাতার ভূতের বাড়ির মধ্যে এক নম্বরে আজও হিট এক নম্বরি গারস্টিন প্লেসের বাড়িটি। এখানেই কলকাতার প্রথম রেডিও অফিস – আকাশবাণী। আজও কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সেই পুরনো বাড়িতেই ভূতেরা যাতায়াত করে। এখানেই এক বিদেশি ভদ্রলোককে ফাঁকা স্টুডিয়োতে দাঁড়িয়ে পোজ দিতে দেখা যায় বলেই শুনেছি। ভূতের এই নিত্য যাতায়াতে রাইটার্স বিল্ডিং-এ দূরে রাখবেন না।
যদিও এখানে এখন আধুনিকীকরণ চলছে। তবুও এই স্থানটিতে সত্যই রাতপ্রহরীরা বহু অশরীরীর পায়ের শব্দ শুনেতে পান। বৃষ্টি রাতে রেকর্ড করতে চাইবেন নাকি সেই পায়ের শব্দ। সেলফি তুলবেন অশরীরীর সাথে। কোট-প্যান্ট-টাই পরা সাহেব ভূতের সঙ্গে পাউট তুলতে চাইলে ঘুরে আসুন। যদি রাইটার্সের ঘরে সাহেব নাও থাকে তিন নম্বর ব্লকের সিঁড়ির ওখানে বুটের ভারী আওয়াজ শুনবেন। বিশ্বাস না হলে দোতলার চার নম্বর ব্লকে দামী স্যুট পরা লাশ আপনাকে দেখা দিয়েও অদৃশ্য হয়ে যাবে, দরজা খুলে কেউ কী ঢুকল ঘরে!
আসলে গোটা ডালহৌসি এলাকাই ভূতেদের রিয়েল এনটিটি। ওদের ভবিষ্যতের সংসার।
তাই তো জিপিওর কোণের ঘরে শোনা যায় নূপুরধ্বনি। সেই বাঈজী নাকি ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমেও আসে। অনেকে আবার নিচে ঘোড়াকে দাঁড়িয়ে মাথা দোলাতেও দেখেছে। কী কান্ড। ঘোড়ার ঘোস্ট ড্রিম! আতরের খুশবু কিন্তু এখনও নির্জনের জিপিও-তে রয়েছে। যাবেন নাকি কোনও কাজে জিপিওতে…তবে রাতেই যাবে। সুন্দরী রমণী আপনাকে আপ্যায়ন করতে পারে।
আহেরিটোলার কাছাকাছি পুতুল বাড়িও ভূতের বাড়ি নামেই খ্যাত। আবার অন্যদিকে মাঝেরহাট ব্রিজের কাছে বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়ির কাছে অনেকেই লাল কুর্তা পরা একটি লোককে দেখেছেন, খুঁজে বেড়াচ্ছেন কাউকে। সেটা আপনি নয়তো! তাকে আমিও জিজ্ঞেস করতে গেছিলাম, এক্কেবারে উধাও! আমিও তখন উসেন বোল্ট। ছুটতে ছুটতে রেসের মাঠের বিপরীত দিকে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে এসে পৌঁছালাম।
অবাক কান্ড আমি ট্যাক্সিটা ধরতে যাব ঠিক তখনই সামনের এক খালি ট্যাক্সিতে কলকাতা পুলিশের এক অফিসার উঠে পিছন সিটে বসে পড়ল। আমিও পিছনের ট্যাক্সিতে উঠে ধাওয়া করলাম। তবে ধরার আগেই সে চিড়িয়াখানার সামনে চলন্ত ট্যাক্সি থেকে নেমে যায়।
সে আবার হেস্টিংসের বাড়িতেই যাচ্ছে না তো। বৃষ্টি রাতে এসব পড়ে ভয় পাবেন না। একটু মাথা হ্যাং করে গেলে গঙ্গার হাওয়া খেয়ে হেঁটে আসুন। ওসব ভূত নেই। শুধু যদি আমার মতো বাগবাজারের গিরিশ ঘোষের বাড়িতে ইতিহাসের লোভে ঢোকেন শুনতে পাবেন, ‘ও বিনু, বিনু এলি!’ অনেকেই নাকি বলেন, গিরিশ ঘোষ নটী বিনোদিনীকে ডাকেন মনে হয়!
>কলকাতার ভূতেরা ইতিহাসের মোটা বই। বোঝাই যায় তারা একটু ভূতের ভবিষ্যতের পুরনো বাড়িতে আস্তানা নেয়। স্বাভাবিক। মানুষ যেখানে ভয় পায় ভূতও সেখানে থাকা শুরু করে দেয়। ওদের নিয়ে বেশি ঘাটানোই ভাল। না হলে আমার মতো শেওড়া গাছে ঝুলিয়ে দেবে। বলছি তো আমি এসব গল্প লিখছি। এগুলো সত্য। আমা কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে হেস্টিংস। লর্ড কার্জন আমাকে বলছে আজই বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেছিলাম। তুই কী ঐ জন্মে রাখী হাতে গান গেয়েছিলি, আমি অনেক বিনয় করে বললাম স্যার আমি তো ক্ষুদিরামের পাশের বাড়িতে থাকতাম, নেতাজীর বন্ধু। আপনি ওদের বি-বি-দী বাগ-এ পাবেন…কোথায় কোথায়…জিজ্ঞেস করতেই দে ছুট…ছুটছি… বলছি তো এসব নিছকই মজার জন্য লেখা, কোনও গুজব নয়, কেবলই ভূতের গল্প, বৃষ্টি রাতে কলকাতার ভূতের গল্প, সবই অদ্ভূতুড়ে…