পথ —— ৪৩
——————
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
জানলার ধারে বসা আমার চিরকালের অভ্যাস। সে ট্রেনের জানলার ধারেই হোক বা
ক্লাসঘরের জানলার ধারে। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমাদের ইতিহাস ক্লাস নিতেন
হিমাংশু চৌধুরী। খুব হাসাতেন। হাসার সময় স্যারের দুটো কানই একটু ওপর দিকে উঠে
যেত, তাই দেখে আমরা আরও হাসতাম।
হিমাংশুবাবু এমনি খুব ভালো মানুষ। সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। চারপাশের
সবাইকে হাসিখুশি রাখতেনও। কিন্তু রেগে গেলে তাঁর মাথার ঠিক থাকতো না। তখন তিনি
যে কী করে ফেলবেন তা কেউ জানে না। ছাত্রজীবনে একবারই মাত্র তাঁকে ওইরূপে
দেখেছিলাম এবং তাঁর ওই বিরল রাগের কারণ ছিলাম আমি।
ইতিহাসের ক্লাস শুরু হয়েছে। আমি জানলার ধারে বসে। আমাদের স্কুলের সামনে
একটা বড় মাঠ ছিল। ক্লাসঘরের জানলা থেকে ওই মাঠটা দেখা যেত। জানলার ধারে বসার
ওটাই আমার একমাত্র কারণ।
গোটা স্কুল জুড়ে প্রত্যেকটা ঘরেই তখন ক্লাস চলছে। খুব চুপচাপ। মাঝে মাঝে
কোনো কোনো ঘর থেকে স্যারের গলা ভেসে আসে। আওয়াজ বলতে এইটুকুই। এইসময়টাতে
জানলা দিয়ে মাঠ দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। স্কুলের বন্দী জীবন আমার মোটেই
ভালো লাগতো না। তাই তখন মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখতাম কেউ মাঠে বেঁধে রাখা গোরুর
গোবর কুড়োচ্ছে, কেউ মাঠের ওপর দিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে দোকান যাচ্ছে, কেউ
ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ওইসব দেখে আমি তখন ইতিহাসের ক্লাস ঘর থেকে অনেক দূরে।
কোনোদিন এমন হয় না। ঘরে বাইরে ভারসাম্য রেখেই চলি। কিন্তু সেদিন একটু
বেশিমাত্রায় মাঠে ডুবে গিয়েছিলাম। কারণ মাঠে দুটো ছেলে ঘুড়ি কাটাকাটি
খেলছিল। তাই ভারসাম্য রাখতে পারিনি। সরাসরি হিমাংশুবাবুর চোখে পড়ে যাই। উনি
আমাকে ডাকলেন। আমি উঠে গেলাম।
ওনার শাস্তি দেওয়ার ধরণটাই ছিল আলাদা। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, “আমি জানি
তোর কবি কবি মন। কিছুতেই ঘরে থাকতে চায় না। ছাত্র বয়সে আমারও এমন হতো। কিন্তু
বাবা, এখন যে স্কুল চলছে —- এটা তো তোমায় মানতে হবে।” তারপরেই মারতে শুরু
করে দিলেন। আমাকে সামনে রেখে যে দিকে পারছেন মারছেন। আমাকে মারা নিয়ে আমার
কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু আমাকে মারতে মারতে উনি এতো কাঁপছেন যে আমার রীতিমতো ভয়
লাগছে —– ওনার কিছু হয়ে যাবে না তো!
আমার সহ্যক্ষমতা খুবই বেশি ছিল। শৈশবে এবং ছাত্রবয়সে এত ছটফটে ছিলাম যে
মার খাওয়াটা আমার কাছে রোজকার ব্যাপার ছিল। সেই আমিও সেদিন মারের চোটে কেঁদে
ফেলেছিলাম। কিন্তু কখনও মনে হয় নি যে আর জানলার ধারে বসব না। এই ঘটনার পরেও
জানলার ধারের জায়গা আমি ছাড়ি নি। মাঠের দিকেও তাকিয়েছি। কিন্তু অবশ্যই
ভারসাম্য রেখে।
***********************