পথ ----- ৪৫ ----------------- হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় স্কুলজীবনে আমি কোনোদিন টিফিন নিয়ে যাই নি। ভাত খেয়ে যেতাম। আর খিদে পেত না। আসলে এই অভ্যাসটার জন্যেও মা। মায়ের বক্তব্য ছিল, একজন ছাত্র খেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে বাড়ি এসে আবার সে খাবে। এটাই তো নিয়ম। ছাত্র স্কুলে গিয়ে খাবে না পড়বে? আমার জীবনের ক্ষেত্রে মায়ের এই নিয়মটা ভীষণ কার্যকরী হয়। আমি নিজেও টিফিনের প্রয়োজন অনুভব করতাম না। আমাদের স্কুলে কিছু ছাত্র টিফিন নিয়ে যেত না। টিফিনের সময় আমরা যে সবাই মিলে খেলতাম তা কিন্তু নয়। অনেকেই খেলত। আমি খুব কমই খেলতাম। স্কুলের টিফিনে অনেকেই বাইরে থেকে বিভিন্ন জিনিস কিনে খেত। আমারও যে ইচ্ছা যেত না তা নয়। কিন্তু আমি জানতাম আমাদের এই সামর্থ্য নেই। তাই স্কুলে পয়সা নিয়ে যাওয়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। স্কুলের টিফিনে আমি বেশিরভাগ দিনই যেটা করতাম সেটা হল অফিসঘরের একটা বিশেষ দিকের জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। জানলার ভেতরের মানুষটা ছিলেন মামুদ স্যার। তাঁর পরনে একটা বহু ব্যবহৃত ময়লা ধুতি আর পাঞ্জাবিটাও ওই একই রকম। ভেলি গুড় দিয়ে শুকনো মুড়ি খাচ্ছেন। সবদিক দিয়ে তিনি আলাদা। আমাকে জানলায় দেখলেই সুর করে বলতেন, "কি খবর, কেমন আছিস? " প্রশ্নটা শুনেই আমি হাসতাম। আর কিছু জিজ্ঞাসা করতেন না। শুনেছিলাম উনি খুব গরিব। আর তখন স্কুলমাস্টারের মাইনে এমন কিছু বেশি ছিল না। ওনার সামান্য কিছু জমি ছিল। তিনি নিয়মিত লাঙল চষতেন। খুব কষ্টেই তাঁর সংসার চলত। আমি তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেন পড়ি। মামুদ স্যার আমাদের ভূগোল পড়াতেন। একদিন বোধহয় ক্লাসে পড়ানোর সময় কথা বলেছিলাম। আর উনি সেটা দেখে ফেলেছিলেন। উঠে এসে ক্লাসের মধ্যেই আমাকে খুব মেরেছিলেন। বেশ মনে আছে, মার থামিয়ে দুটো হাতের তালু আমার চোখের সামনে ধরে বলেছিলেন, " এই দ্যাখ, লাঙল চষা হাত। মেরে শেষ করে দোব। " সেদিন টিফিনের সময় আমি জানলার কাছে যাই নি। মামুদ স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি এসে জানলার কাছে দাঁড়ালাম। উনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। আমি মাথা করে নিচু দাঁড়িয়ে আছি। " কী হয়েছে " ------ বলেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর উনিও কাঁদছেন, আমিও কাঁদছি। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। "কেন এমন করিস বল তো?" এমন শিক্ষক সত্যিই আমি জীবনে খুবই কম দেখেছি। পিতার মতো ছাত্রকে এইভাবে বুকে জড়াতে ক'জন পেরেছে? এমন উদার হৃদয়ের মানুষই আমরা ক'জন দেখেছি? **********************