Home ব্লগবাজি পথ ~ ৪৮ – হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

পথ ~ ৪৮ – হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

পথ ~ ৪৮ – হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
পথ ----- ৪৮
-----------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়




     ঘুড়ির প্রতি আমার এক অদম্য টান। কাঠিতে জড়ানো কিছু সুতো। হাত কুড়িও
হবে না। ঘুড়ি উড়ছে আর আমার হাতে তার শরীর বাঁধা। সে চেষ্টা করলেও আমার কাছ
থেকে অন্য কোথাও উড়ে যেতে পারবে না। যদিও এটা আমাকে তৃপ্তি দিতো না। হাওয়ায়
ঘুড়িটা উড়ছে ---- এটা দেখতেই আমার কী ভালো যে লাগতো। আমার মনে হতো সে যেন
অন্য কোনো দেশের বার্তা আমার কাছে নিয়ে আসছে।
     আমাদের ঘুড়ি বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে আকাশে উড়ত না। বিশ্বকর্মা পুজো
উপলক্ষে যে ঘুড়ি ওড়ানো হয় সেটাই আমি জানতাম না।
     আমাদের বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হতো ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। আর ফলাফল
প্রকাশিত হতো ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। মাঝের এই ক'টা দিন আমরা একেবারে মুক্ত
বিহঙ্গ। পড়াশোনা থাকত না। তাই সকালবেলা কিছু খেয়েই বেরিয়ে পড়তাম। হাতে
গাছের একটা ভাঙা ডাল। তাতে কিছু সুতো জড়ানো। ঘুড়ি ওড়াবার জন্য যে বিশেষ
সুতো তা কিন্তু নয়। বাড়ি থেকেই জোগাড় করা। ছোড়দি সেলাইয়ের কাজ করত। তার
কাছ থেকেই সুতো লুকিয়ে নিতাম। আর একটা পাঁচ পয়সা দামের ঘুড়ি। নিজেকে উড়িয়ে
দেওয়ার এত সস্তা পদ্ধতি তখন আমি আর খুঁজে পেতাম না।
     পুকুরে মেছুরেরা যেমন একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে ছিপ ফেলে। আমরাও
তেমনি একটু দূরে দূরে বসে ঘুড়ি ওড়াতাম। "লোটা" শব্দটা সম্পর্কে তখন আমি
অন্তত বিশেষ পরিচিত ছিলাম না। পরে দেখতাম অনেকেই ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা খেলছে।
আমি ওই পথ মারাতাম না। কারণ অনেক কষ্ট করে জোগাড় করা সুতো একবার কেটে গেলে আর
পাবো না।
     একটা গাছের নিচে বসে ঘুড়ি উড়িয়ে দিতাম। একটু ভালো হাওয়া থাকলে এত
সুন্দর ভাবে উড়ত যে তা চোখ চেয়ে দেখার মতো। খিদে পেলে সুতোর কাঠিটা নরম
মাটিতে পুঁতে দিয়ে বাড়ি থেকে লুকিয়ে আনা মুড়ি খেতাম। কারণ দিদি এইভাবে
বাইরে মুড়ি খাওয়া পছন্দ করত না।এদিকে আমারও এইভাবে মুড়ি খেতে ভালো লাগতো
তাই চুরি করতেই হতো।
     শীতের দুপুরে মিষ্টি রোদে মাঠে যেন একটা উৎসবের আমেজ। সব ধান কাটা হয়ে
গেছে। মাঠ একেবারে ফাঁকা। আর আমরা সবাই ঘুড়ি ওড়ানোয় ব্যস্ত। যেহেতু আমি
কাটাকাটির মধ্যে যেতাম না তাই অনেকেই আমাকে ঘুড়ি কেটে দেবার ভয় দেখাত। অনেক
কষ্টে আমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচতে হতো।
     এমন এক একদিন হতো যখন মাঠে বিশেষ কেউ থাকতো না। অথবা ঘুড়ি উড়িয়ে সবাই
আগে চলে যেত। আমি মাঠে একা। দূরে দূরে দু'একজন। আমার চোখের সামনে আমার ঘুড়ি
উড়ছে। আমার মনের ঘুড়ি। অনেকদিন এক জায়গায় বাঁধা থাকার পর আমি যেন বাতাসে
ভেসে বেড়াচ্ছি। অনেক না পাওয়ার মাঝে এটা যেন আমার এক বড় পাওয়া। ওড়ার
আনন্দ আমার সব অভাবকে মুছে দিতো।



                         ********************

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here