পথ ----- ৪১
----------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুজোর সময় বাড়ির সবাই দলবেঁধে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার আনন্দ আমি কোনোদিন পাই
নি। মা খুব একটা বাইরে বের হওয়া পছন্দ করত না। পুজোর সময় মা দু'একদিন
সন্ধ্যেবেলা কাকিমা জেঠিমাদের সাথে আরতি দেখতে যেত। বাকি সব সময় বাড়িতে।
দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর সকালেই বাবা পুজো করতে চলে যেত বাড়ি থেকে অনেক
দূরে। পুজোর সময় বাবাকে কোনোদিন কাছে পাই নি। বন্ধুদের দেখতাম বাবা মায়ের
সাথে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা কখনও সম্ভব হয় নি।
লোকের মুখে শুনতাম বাবা নাকি খুব সুন্দর পুজো করত। সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনে
সে পথ হাঁটত। ফাঁকি বলে কি জিনিস বাবা জানত না। ব্যক্তিগত জীবনেও তাকে দেখেছি
কখনও অস্থির অধৈর্য হয়ে ওঠেন নি। যেখানে যতটুকু দরকার সেখানে ততটুকু সময়
দিয়েছেন। তাই অনেক দূর দূর থেকে বাবার পুজোর ডাক আসত।
বাবা যখন পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে বেরিয়ে যেত পুজো করতে তখন কিছু বুঝতে
পারতাম না। বাবার পুজোর প্রশংসায় মন প্রাণ ভরে থাকতো। আবার এটাও তো সত্যি,
পুজোর শেষে বাবা কত খাবার, কাপড়, গামছা, চাল নিয়ে আসতো। আমাদের অভাবের
সংসারে তা যেন এক বসন্তের মতো। কী ভালো যে লাগতো!
কিন্তু পুজোর সময় বাবার না থাকা আমাকে ভীষণভাবে একা করে দিত। এমন অনেক
কথা থাকত যা বাবাই শুধু বুঝতো। বাবার সাথে হাত ধরে অনেক জায়গায় যেতে পারতাম।
এসব কিছুই হতো না। বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতাম ঠিকই কিন্তু সেটা অন্য আনন্দ।
পুজোর সময় বাবার অনুপস্থিতি কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হওয়ার নয়।
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব একা। কোনো কিছু নিয়ে হৈচৈ চিৎকার চেঁচামেচি আমার
স্বভাবে নেই। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে বাবাকে কাছে না পাওয়া আমাকে আরও একা করে
দিয়েছে।
একবার আমি বাবার পুজো দেখেছিলাম। বড় পিসিমার বাড়িতে হুগলী জেলার
খানপুরে। বাবার চণ্ডীপাঠ আমি জীবনে ভুলতে পারবো না। কী অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠে
চণ্ডীপাঠ। পাঠ করতে করতে বাবাকে আমি কাঁদতেও দেখেছি। মানুষটা তার ভালোবাসার
জিনিসের মধ্যে এমনভাবে ঢুকে যেতে পারতো যে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ভালো
থাকার উপাদান বাবা এখান থেকেই পেয়ে যেত। কোনো জিনিসকে অন্তর থেকে ভালোবাসতে
পারলে তা থেকে যে কী পরিমাণ বেঁচে থাকার অক্সিজেন পাওয়া যেতে পারে, চোখের
সামনে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমার বাবা। আর সেইজন্যই তো হাজার অভাবের মধ্যেও
বাবা রাজার মতো বেঁচে গেছে।
**********************
Related