ওয়েব ডেস্কঃ আমরা শুধু নিজেদের কষ্টের কথাই ভাবি। একবার ভেবেও দেখি না পশু পাখি সকলের মন রয়েছে। তাদের কষ্ট হয়। আমার বাড়িতে একসময় টিঙ্কু ছিল। সে আমার দুঃখ বুঝতে পারলে নিজেও খেত না। আজ সেই পাখির কথাই বলব আপনাদের। ভারতের আসাম রাজ্যের দিমা হাসাও জেলার একটি গ্রাম হল জাতিঙ্গা। গ্রামটি পাখিদের মৃত্যু উপত্যকা নামে পরিচিত। মাত্র আড়াই হাজার জনগোষ্ঠির এই গ্রামটি প্রাকৃতিক ভাবে সৌন্দর্যে ভরপুর। তার একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। জাতিঙ্গা প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সম্পদে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলটির রয়েছে এক রহস্যঘেরা দিক। প্রায় একশ বছর ধরে হাজার হাজার পাখি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিচ্ছে এই নির্দিষ্ট স্থানটিতে। কেন বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হাজার হাজার পাখি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেয়, তা আজও জানা সম্ভব হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞই জাতিঙ্গার এই রহস্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত নয়। জাতিঙ্গার রহস্য আজও তাই অধরা রয়ে গেছে অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে…
প্রাচীন হিন্দু পুরাণে এক ব্রাহ্মণ আর তার সন্তানের কথা রয়েছে। ভাগ্যের ফেরে বিপদে পড়া এক ব্রাহ্মণ তার সন্তানকে নিয়ে গহীন জঙ্গলে গাছতলায় আশ্রয় নেন। সারারাত ক্ষুধায় কষ্ট করতে থাকা ব্রাহ্মণ আগুন জ্বালিয়ে কথা বলতে থাকেন তার সন্তানের সঙ্গে। তারা যে গাছটির নিচে বসে কথা বলছিলেন, সেই গাছের উপরই ছিল শুকসারি নামক এক পাখি পরিবার। গাছের নিচের মানুষ দুটোর কষ্টের কথা, ক্ষুধার কথা শুনে উপরের পাখি পরিবারের কনিষ্ঠ বাচ্চাটি হঠাৎ করেই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেয়, যাতে ব্রাহ্মণ আর তার সন্তান ঝলসানো পাখির মাংস খেয়ে ক্ষুধা মেটাতে পারে। যদিও বাচ্চা পাখির মাংস খেয়ে তাদের পেট ভরেনি, তখন একে একে বাবা-মা পাখি দু’জনেই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেয়। আসলে এ এক প্রাচীন মিথ কথা।
এই একবিংশ শতাব্দীতে কেন তবে জাতিঙ্গায় হাজার হাজার পাখি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেয়। কেনই বা পাখিদের মধ্যে এই আত্মহত্যার প্রবণতা। আর কাদেরইবা প্রাণে বাঁচাতে চাইছে এই পাখিরা, মানব সভ্যতাকে? নাকি এর পেছনে রয়ে গেছে আরও গভীর কোনো রহস্য, যা ভেদ করতে আজও সক্ষম হয়নি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ!
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চাঁদহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতগুলো জাতিঙ্গার পাখিদের জন্য আত্মহত্যার শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়টাতেই মূলত জাতিঙ্গা গ্রামে পাখিরা আত্মাহুতি দিতে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রায় ৪৪ প্রজাতির পাখি সন্ধ্যে ছটা থেকে রাত সাড়ে নটার মধ্যে আত্মাহুতির জন্য ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকে। গ্রামবাসীদের অনেকে এ সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারা পাখি ধরার জন্য আগুন জ্বেলে বাশের তৈরি খাঁচা নিয়ে অপেক্ষা করে। যখনই পাখিরা ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে তখন গ্রামবাসীরা পাখিগুলোকে ধরে খাঁচায় পুরে নেয়।
প্রতিবছরই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। যদিও এই পাখিরা জাতিঙ্গা গ্রামের প্রায় ১৫০০ থেকে ১৬০০ মিটার নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই এমনটা করে থাকে। এই নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে তাদের এ আচরণ দেখা যায় না। অনেকেই দাবি করেন যে, নির্দিষ্ট ওই এলাকার উচ্চতা, বাতাসের চাপ এবং কুয়াশার কারণে পাখিরা দিকভ্রান্ত হয়ে ঝাঁপ দেয়। আর উজ্জ্বল আলো এমনিতেই পাখিদের দিকভ্রান্ত করে দেয়। অন্য সূত্র মতে, নির্দিষ্ট ওই এলাকায় অতি উচ্চমাত্রার কোন চৌম্বকক্ষেত্র থাকতে পারে, যার কারণে পাখিরা ক্রমেই নিচের দিকে ঝাঁপ দিতে উৎসাহী হয়।
ভারতের বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তারা অনেকবারই ওই অঞ্চলে পাখিহত্যা বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছেন, গ্রামবাসীদের নিষেধ করার চেষ্টা করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন রকমের শিক্ষা কার্যক্রমও চালু করেছেন। ফলে বিগত কয়েক বছরে পাখি হত্যার হার প্রায় চল্লিশ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে আসামের সরকার এই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ঘটনাকে পুঁজি করে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের আকৃষ্ট করে থাকেন। যে কারণে ভ্রমণকারীদের জন্যে চমৎকার রেস্ট হাউজ গড়ে উঠেছে এখানে।
আজও জাতিঙ্গায় কেন পাখিরা বছরের এই সময়ে আত্মাহুতি দেয় তা অজানা। তবে পৃথিবীতে জাতিঙ্গাই একমাত্র জায়গা নয় যেখানে এমনটা ঘটে থাকে। ভারতের মিজোরাম, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনে এরকম জায়গার সন্ধান পাওয়া যায়, যেখানে পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আত্মাহুতি দেয়। পরে বলব একদিন সে সব কথা। তাহলে একবার জাতিঙ্গা…