বর্ষাকালে বৃষ্টিকে ধাওয়া করায় বেশ চ্যালেঞ্জিং একটা আনন্দ আছে, তৈরি হয়ে নিন ছাতা, রেনকোট নিয়ে। আমার মতো বৃষ্টিকে যারা ভালবাসেন তারা এই ভরা-বর্ষায় আক্রমন করতেই পারেন মেঘের বাড়ি মেঘালয়কে।
কলকাতা থেকে ট্রেনে বা ফ্লাইট-এ গুয়াহাটি , সেখান থেকে বাস বা ক্যাব নিয়ে শিলং যেতেই পারেন, পুরো গাড়ি ভাড়া করলে ১০০ কিমি রাস্তা ৩ঘন্টায় নিয়ে যেতে গাড়ি ভাড়া পড়বে ৩০০০/- এর কাছাকাছি, বাস ভাড়া শুরু ১৩৫/- টাকা থেকে, শেয়ার ট্যাক্সি ৩০০/- টাকা মাথাপিছু থেকে শুরু। পাহাড়ি পথ বেয়ে আস্বাদন করুন উত্তর পুর্বের অনাবিল সৌন্দর্য্য।
শিলং বেশ জনপ্রিয় একটি পর্যটন শহর। প্রায় ৬,০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত শিলং শহর এবং তার আশেপাশে দেখার জন্য অনেক সুন্দর জায়গা আছে। বিশেষত পুরো পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার জন্য শিলংকে বেছে নিতে পারেন।
এখানে রয়েছে পাইন অরণ্য, জলপ্রপাত এবং পার্বত্য জলধারার সমারোহ। ১৮৯৭ সালে এক ভূমিকম্পে শহরটি ধবংস হয়ে যায় এবং এরপর এটিকে ব্রিটিশরা পুনরায় গড়ে তোলেন । শহরের কোণায়-কোণায় ব্রিটিশ স্থাপত্যই বলে দেয় কেন একে ”প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’’ বলা হয়।
পুলিশ বাজার ও সেন্টার পয়েন্টে বিভিন্ন বাজেটের হোটেল পেয়ে যাবেন। যদি দুপুরের ভেতর শিলং পৌঁছে যান দেখে আসতে পারেন কাছাকাছির ঘোরার জায়গাগুলী~
এলিফ্যান্ট ফল্স~
মাত্র ১৩কিমি দূরত্বে অবস্থিত এই জলপ্রপাতে পৌঁছতে লাগে আধ ঘন্টা সময়, প্রকৃতি দুহাত ভরে সাজিয়েছেন এই জায়েগাটিকে ছবির মতো সাজানো ঝর্না কাটিয়ে দেবে আপনার যাবতীয় ক্লান্তিকে।
শিলং ভিউ পয়েন্ট ‘শিলং পিক’~
‘শিলং পিক’ ১৯৬৫ মিটার উচ্চতায় মেঘালয়ের উচ্চতম পয়েন্ট, চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা সম্পূর্ন শিলং শহরটাকে ক্যামেরাবন্দি করার একটা অপূর্ব সুযোগ পাবেন। এছারা খাসিয়া রাজা-রাণির পোশাকে সেলফি ও তুলতে পারবেন এখানে।
বড়াপানি বা উমিয়াম লেক~
ছবির মত সুন্দর এই লেক শিলং এর থেকে ১৫কিমি উত্তরে অবস্থিত, ১৯৫৭-১৯৬২ সালে নির্মিত এই জলাধারটি ২০০বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে উমিয়াম নদীর জলকে ধরে রেখেছে। বিকেলে দেখেই আসতে পারেন উমিয়াম লেক।
এছাড়া ডন বস্কো মিউজিয়াম, ওয়ার্ড লেক যেতেই পারেন যদি আরেকটা দিন শিলং-এই কাটাতে চান । পরেরদিন পাড়ি দিতে পারেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত শহর ডাউকিতে সেখান থেকে চেরাপুঞ্জি ~
শিলং থেকে NH 206 ধরে ডাউকি যেতে সময় লাগবে ২ঃ৩০ ঘন্টা, ৮২ কিমি রাস্তা পেরতে হবে তাই সকাল সকাল বেরোনোই আদর্শ…
ডাউকি~
ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তে পাহাড়ে ঘেরা ডাউকির বুক চিরে দুই দেশকে ভাগ করেছে উম্নগোট (Umngot) নদী। এর এক পাড়ে ভারত এক পাড়ে বাংলাদেশ, সীমান্তে অবস্থান এর ফলে ডাউকি শহরটি হয়ে উঠেছে পর্যটন আর ব্যাবসা-বাণিজ্যের এক কেন্দ্র।
উম্নগোট নদীতে নৌকাবিহার করতে করতে আপনার মনে হবে আপনি দূর কোনো পশ্চিম এর দেশে এসে পড়েছেন, মাঝি দের সাথে একটু দর-দাম করে চড়েই পড়ুন নৌকোতে, ক্যামেরার খিদে মেটানোর জন্য অনেক রসদ পেয়ে যাবেন।
ডাউকি লাগোয়া তামাবিল হোলো সীমান্তের চেক পোস্ট, স্থানীয় হোটেল এ সেরে নিতে পারেন দুপুরের খাওয়ার পালা। মোমো-থুকপা-চাউমিন এর পাশাপাশি পেয়ে যাবেন স্থানীয় ভাতের হোটেলও। ডাউকি থেকে চলে যান Mawlynnong বা মৌলিনং এবং সেই পৃথিবী বিখ্যাত জীবন্ত Root Bridge দেখতে… পৌঁছতে সময় লাগবে ১ঃ৩০ ঘণ্টা।
মৌলিনং~
Mawlynnong বা মৌলিনং পরিচিত এশিয়ার সব থেকে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসাবে, প্রকৃতি এখানে তার চিরসুন্দর রূপ নিয়ে ব্যস্ত আর মানুষ তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞতা স্বীকারে। খাসি পর্বতের পূর্বের এই গ্রাম আর তার লাগোয়া রিওয়াই গ্রাম এখন ভ্রমণ পিপাসুদের প্রথম পছন্দের তালিকায়।
এখানে পেয়ে যাবেন মাথা গোঁজার জন্য বেশ কিছু হোম-স্টে কটেজ, প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে রাতটা কাটিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ুন আশেপাশের স্পট গুলি খুঁজতে…
বাংলাদেশ ভিউ পয়েন্ট~
স্থানীয়দের হাতে গড়া, সম্পুর্ন বাঁশ দিয়ে তৈরি এই সিঁড়ি বেয়ে উপরে গিয়ে দেখুন মৌলিনং ও তার আশেপাশের দৃশ্যাবলী, প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশ এর ভিউ ও পাবেন এখান থেকেই, মানুষের তৈরি এই গাছবাড়ির ভিউ পয়েন্টই এখানকার সবথেকে উঁচু জায়গা।
প্রাকৃতিক ব্যালান্সিং রক~ (Maw Ryngkew Sharatia)
কয়েক হাজার বছর ধরে এই বিশাল পাথরটি দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট্ট পাথর এর উপর ভর দিয়ে, কোনও ভুমিকম্প বা প্রাকৃতিক দূর্যোগ আজ অব্ধি টলাতে পারেনি একে।
একটু হেঁটে পাশের গ্রাম রিওয়াই এ পৌঁছে যান সেই পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিজ দেখতে,
জীবন্ত রুট-ব্রিজ , রিওয়াই~
স্থানীয় মানুষের তৈরি এই একতলা / দোতলা ব্রিজগুলি দুইপাড়ের দুটি রাবার জাতীয় গাছের শিকড়কে একত্র করে বানানো, এটি সম্পূর্ণ জীবন্ত এবং প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। এই ব্রিজগুলি এক গ্রাম কে অন্য গ্রামকে সংযুক্ত রাখে, এদের এক একটির বয়েস ৮০-১০০ বছরেরও বেশী।
মূলত, দুটি গাছের মাঝামাঝি একটি বাঁশকে এদিক থেকে অন্যদিকে পেতে দেওয়া হয়, গাছের শিকড় সেটিকে জড়িয়ে দুদিক থেকেই এগোতে থাকে, যখন মাঝখানে এসে মিলিত হয়ে এরা শক্ত আকার ধারণ করে তখন মাটি ও পাথর দিয়ে এর ফাঁক গুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সারাবছরই এই প্রাকৃতিক সেতুর মেরামত এর কাজ চালিয়ে যেতে হয়।
এখানে স্থানীয় খাবার দিয়ে সাজিয়ে ফেলতে পারেন আপনাদের মধ্যাহ্নভোজ, সুন্দর ঢেঁকিছাচা চাল এর ভাত, সাথে শুঁটকি মাছ আর ঝাল চাটনি, ট্রাই করতে পারেন পোর্ক, আর সবজি দিয়ে তৈরি স্যালাড যার স্থানীয় নাম “দোখলিয়ে” (Dohkhlieh)
দুপুরের লাঞ্চ সেরে বেড়িয়ে পড়ুন, চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে ~
চেরাপুঞ্জি মানেই বৃষ্টি আর মেঘ, মেঘের সাথে ধাক্কা খাবেন- পায়ের কাছে লুটোপুটি খাবে মেঘেরা। নিজের বাজেট অনুযায়ী বেছে নিন হোটেল-লজ বা হোম-স্টে। শিলং থেকেই সরাসরি বেশীরভাগ থাকার ব্যাবস্থা করে দেওয়া হয়।
ঘরের জানলা দিয়ে বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারা দেখতে ভাল লাগলেও বাইরে বের হতে দরকার পড়বে ছাতা, বর্ষাতি ও রবারের জুতো। রওনা হওয়ার আগে সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। সর্দি, কাশি, জ্বর, মাথাব্যাথা ও সাধারণ পেটের অসুখের ওষুধ সঙ্গে রাখা উচিত । এখানে বৃষ্টির সাথে আপোষ না করেই বেড়িয়ে পড়ুন আশে পাশের ভিউ দেখতে, সারাদিনের জন্য ভাড়া করে নিতে পারেন গাড়ি, ভাড়া পরবে ২০০০ টাকার কাছাকাছি।
কাছেপিঠের যে জায়গা গুলি দেখতে ভুলবেন না~
ডুয়ান-সিং-সিয়েম ব্রিজ ও ভিউ পয়েন্ট
Eco Park ইকো-পার্ক
Eco Park ইকো-পার্ক
Maw Trop বা অশুভ দৈত্য
অশুভ দৈত্য নামক পাথরটি খাসিয়াদের উল্টানো চোঙাকৃতির ঝুড়ির মত। প্রচলিত লোক কাহিনী মতে পাথরের ঝুড়িটি একটি অশুভ দৈত্যের, যে নাকি মানুষের ক্ষতি সাধন করে বেড়াত। দৈত্যটির হাত থেকে মুক্তির জন্য মানুষ তাকে ধারালো লোহা এবং পেরেক মিশ্রিত খাবার খেতে দেয়, এতে করে দৈত্যটির মৃত্যু ঘটে। দৈত্যটি যে ঝুড়ি ফেলে গিয়েছিল সেটি ২০০ ফুট উঁচু পাথরে পরিণত হয়।
Thangkharang Park
Nohkalikai falls
Ki Likai নামে একটি একজন যুবতী মহিলা ছিল, তার একটি কন্যা সন্তান ছিল। মহিলাটির ২য় বিয়ে হয়। লোকটি ছোট মেয়েটিকে খুব ঘৃণা করত। মহিলা একদিন মাঠ কাজ করতে গেলে লোকটি ছোট মেয়েটিকে মেরে সুপারি রাখার ঝুরির মধ্যে ঢুকিয়ে ঢাকনা আটকিয়ে দেই। মহিলা কাজ ফিরে এসে দেখে তার স্বামী তার জন্য রাতের খাবার রান্না করে রেখেছে, এতে সে বিস্মিত হয়। তারপরেও সে কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়া খাবার গ্রহণ করে। মহিলাটি পরে ঝুরির মধ্যে থেকে বের হয়ে আসা তার মেয়ের আঙুল দেখতে পায়। সহ্য করতে না পেরে ঝর্নায় আত্মহত্যা করে। সেইথেকে ঝর্নাটি ‘Nohkalikai falls’ নামে পরিচিত।
মৌসিনরাম~
গোটা দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় মৌসিনরামে। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড এমনটাই বলছে। তাই বর্ষাকালে ঝমঝম বৃষ্টি উপভোগ করার অন্যতম ঠিকানা মৌসিনরাম। পূর্ব খাসি হিলের গায়ে রয়েছে এই বৃষ্টি ভেজা গ্রাম। আগে চেরাপুঞ্জিকে বলা হলেও, এখন মৌসনরাম বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিভেজা জায়গা।