ওয়েব ডেস্কঃ একসময় ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল কলকাতা। এই কলকাতার মাটিতে বসেই সারা ভারত শাসন করেছিল ব্রিটিশ উচ্চ পদাধিকারীরা। পরে দিল্লি রাজধানীতে পরিণত হলেও ইতিহাস ও স্থাপত্যকলার বহু নিদর্শন থেকে যায় সারা বাংলা জুড়ে। এদিকে, ইংরেজদের ভারত আগ্রাসনের আগে এদেশে রাজত্ব ছিল মোঘলদের। সেই সুবাদে বাংলার শেষ নবাব ছিলেন সিরাজদৌল্লা। ফলে ইতিহাস ও স্থাপত্যকলার প্রচুর নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সারা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা সেই সমস্ত রাজন্য আমলে তৈরি হওয়া নানান স্থাপত্য, স্মৃতি সৌধগুলি ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে ধরবো যেগুলি বর্তমানে ভারতের “আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া”-র তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
কোচবিহার রাজবাড়ি, কোচবিহার…
কোচবিহার রাজবাড়ি উত্তরবঙ্গের একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। কোচবিহার রাজবাড়ি এরঅপর নাম ভিক্টর জুবিলি প্যালেস। ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণে রাজত্বকালে লন্ডনের বাকিংহ্যাম প্যালেসের আদলে এই রাজবাড়িটি তৈরি হয়েছিল। কোচবিহার এই রাজবাড়ি ইট দিয়ে তৈরী করা হ্য। মোট ৫১,৩০৯ বর্গফুট (৪,৭৬৬.৮ মি২) এলাকার উপর ভবনটি অবস্থিত। বাড়িটি ৩৯৫ ফুট (১২০ মি) দীর্ঘ ও ২৯৬ ফুট (৯০ মি) প্রশস্ত। এর উচ্চতা ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি (১.৪৫ মি)। ভবনের কেন্দ্রে একটি সুসজ্জিত ১২৪ ফুট (৩৮ মি) উঁচু ও রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত হলঘর রয়েছে। এছাড়া বাড়িতে রয়েছে ড্রেসিং রুম, শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার, তোষাখানা, লেডিজ গ্যালারি ও ভেস্টিবিউল। যদিও এই সব ঘরে রাখা আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রী এখন হারিয়ে গিয়েছে।
রাসমঞ্চ, বিষ্ণুপুর…
রাসমঞ্চ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গগত বিষ্ণুপুর শহরের একটি পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা। বিষ্ণুপুর থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরে এটি অবস্থিত। মল্লরাজা বীরহাম্বীর আনুমানিক ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এই মঞ্চটি নির্মাণ করেন। ১৬০০ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত এখানে রাস উৎসব আয়োজিত হয়েছে। বর্তমানে অবশ্য এখানে আর উৎসব হয় না। রাসমঞ্চ একটি অভিনব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। মঞ্চের বেদিটি মাকড়া বা ল্যাটেরাইট পাথরে নির্মিত। বেদিটির উচ্চতা ১.৬ মিটার ও দৈর্ঘ্য ২৪.৬ মিটার। মঞ্চটির মোট উচ্চতা ১০.৭ মিটার। উপরের অংশ ইট দিয়ে নির্মিত। চূড়ার কাছে একটি স্বল্প পরিসর ছাদে গিয়ে উপরের অংশটি মিলিত হয়েছে। রাসমঞ্চের চূড়া পিরামিডাকৃতির। চূড়ার মূলে চারটি করে দোচালা ও প্রতি কোণে একটি করে চারচালা রয়েছে। গর্ভগৃহটি দেওয়াল-দ্বারা আবৃত নয়, বরং রাসমঞ্চের গর্ভগৃহটিকে ঘিরে রয়েছে তিন প্রস্থ খিলানযুক্ত দেওয়াল। বাইরের সারিতে খিলানের সংখ্যা ৪০। এই খিলানগুলির গায়ে পোড়ামাটির পদ্ম ও পূর্ব দেওয়ালে বিষ্ণুপুরের গায়ক-বাদকদের স্মৃতি-অলংকৃত কয়েকটি টেরাকোটার প্যানেল রয়েছে। রাসমঞ্চটি বিষ্ণুপুরের প্রচলিত স্থাপত্যরীতি অনুসরণে নির্মিত হয়নি।
জোড় বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর…
জোড়-বাংলা রীতির মন্দির স্থাপত্য এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় বেশ কিছু থাকলেও বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলা আপন স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ঠে সমুজ্জ্বল। জোড়বাংলা মন্দির যে ‘বাংলার ঘরের চাল’এর আদল তা কেবল বঙ্গেই প্রচলিত । জোড়বাংলা মন্দিরে প্রাপ্ত লিপি অনুসারীই মন্দিরটি ৯৬১ মল্লাব্দে(১৬৫৫ খ্রীস্টাব্দ) মল্ল রাজ রঘুনাথ সিংহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।দু’খানি দুচালা ‘বাংলার কুটির ঘর পাশাপাশি জুড়ে দিলে যা হয় তাই জোড়বাংলা।’বাংলার মন্দির নির্মানের অপূর্ব নিদর্শন এই ‘জোড়বাংলা’। মাটি ইট দিয়ে এর দেওয়াল তৈরী হয়েছে। ভিতরে ও বাইরে মাটির দেওয়ালের উপ ভার্স্কয্য খচিত চিত্র দিয়ে সুসজ্জিত।জোড়বাংলা মন্দিরের গঠন শৈলী বর্ণনা করে “Archaeological survey of India” রায় দিয়েছে যে এই মন্দির টি “কেষ্টরায়”মন্দির নামেও পরিচিত।
ক্লাইভের বাড়ি, দমদম…
উত্তর ২৪ পরগনার দমদম এলাকায় রবার্ট ক্লাইভ বাড়ি একটি দর্শনীয় স্থান। ব্রিটিশ অফিসার হিসাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করেন।রবার্ট ক্লাইভ যখন ভারতবর্ষে আসেন, সেই সময় তার ব্যক্তিগত বাসভবন হিসেবে বাড়িটিকে ব্যবহার করা হত। ১৯৫৮ সালে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে যুদ্ধে পরাজিত করার পর রবার্ট ক্লাইভ এই বাড়িটিকে দখল করেছিলেন। আশ্চর্য জনক ভাবে বাড়িটির স্থপতি বা মালিকের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। রবার্ট ক্লাইভ আসার পর বাড়িটির মূল কাঠামোকে একই রেখে বাড়িটির স্থাপত্যের পরিবর্তন করেন। মূল কাঠামোকে একই রেখে, তিনি যে পরিবর্তন আনেন তা তৎকালীন ইংল্যান্ডের স্থাপত্য শিল্পের প্রতিভূ।রবার্ট ক্লাইভের পরবর্ত্তী সময় বাড়িটি বহুবার হস্তান্তর হয়। ১৮৯০ সালের কলকাতা গেজেট থেকে যানা যায় যে, বাড়িটির অভ্যন্তরের পাতালগর্ভে কোন গুপ্ত ঘর থাকলেও থাকতে পারে। পরবর্ত্তীকালে ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রতিষ্ঠিত পুরাতত্ব বিভাগ অনুসন্ধান চালিয়ে সেই গুপ্ত ঘরের কোন হদিশ না পেলেও তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেনি। বাড়িটির বহু হস্তান্তরের পরে, ১৯৭০ সালে এটি পরিত্যক্ত হয়।বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটির কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়ার সাথে সাথে ইতিহাসও আজ কালের গভীরে বিলুপ্ত হতে চলেছে।
লুকোচুরি দরজা, মালদহ…
মোঘল বাদশা শাহজাহানের সময়ে এই স্থাপত্যটি তৈরি হয়। মালদহের গৌড়ে এটি অবস্থিত। বাংলায় মোঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এটি। ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা গৌড় দুর্গে প্রবেশ করবার জন্য এই ফটক বা দরোয়াজাটি তৈরি করেন। উচ্চতা ৬৫ ফুট ও চওড়া ৪২ ফুট। দুইদিকে প্রহরীদের ঘর ও ওপরে নহবতখানা আছে। লুকোচুরি ফটক বা দরোয়াজা দিয়ে গৌড় দুর্গে ঢোকার পর ডানদিকে রয়েছে কদমরসুল সৌধ। এখানে রয়েছে হজরত মহম্মদ(সাঃ) এর পদচিহ্ন, যেটা সুদূর আরব থেকে পীর শাহ্ জালাল তাব্রেজী এনেছিলেন পান্ডুয়া-র বড় দরগায়, সেখান থেকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এটিকে নিয়ে আসেন গৌড় দুর্গে। তাঁর পুত্র সুলতান নসরত শাহ ১৫৩০ সালে একটি কষ্ঠি পাথরের বেদির ওপর পদচিহ্নটি স্থাপন করে তার ওপর কদম রসুল সৌধ নির্মাণ করেন।
হাজারদুয়ারি, মুর্শিদাবাদ…
১৯ শতকে এই প্রাসাদটি গড়ে ওঠে। বাকিংহ্য়াম প্রাসাদের আমলে এটিও তৈরি হয়েছে। এটিতে এক হাজারটি দরজা বা দুয়ার রয়েছে বলে এমন নামকরণ করা হয়েছে।কলকাতা থেকে ১৯৭ কিমি দূরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের স্মৃতি বিজড়িত মুর্শিদাবাদ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকাভুক্ত।মুর্শিদাবাদ শহরের সেরা আকর্ষণ হাজারদুয়ারি । ১৮৩৭ সালে নবাব নাজিম হুমায়ুন খাঁয়ের জন্য ৮০ ফুট উঁচু তিনতলা গম্বুজওয়ালা এই প্রাসাদটি নির্মিত হয়। আদপে ৯০০টি দরজা হলেও আরও ১০০টি কৃত্রিম দরজা রয়েছে প্রাসাদে। তাই নাম হাজারদুয়ারি। প্রাচীন মুর্শিদাবাদের স্মৃতি নিয়ে অপরূপ গথিকশৈলীর এই প্রাসাদ এখন মিউজিয়াম। আক্ষরিক অর্থেই এ এক ঐতিহাসিক জাদুঘর। নীচের তলায় রয়েছে তৎকালীন নবাবদের ব্যবহৃত প্রায় ২৭০০টি অস্ত্রশস্ত্র। যার মধ্যে আলিবর্দি ও সিরাজের তরবারি এমনকী যে ছুরিকা দিয়ে মহম্মদি বেগ সিরাজকে খুন করেছিল তা পর্যন্ত রক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়। এই সুরম্য বিশাল রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে দেখা যায় রুপোর সিংহাসন যেটি ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী মহারানি ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার। ১৬১টি ঝাড়যুক্ত বিশাল ঝাড়বাতির নীচে সিংহাসনে বসে নবাব দরবার পরিচালনা করতেন।
মিনার, পাণ্ডুয়া…
হুগলির পাণ্ডুয়াতে এই সৌধটি অবস্থিত। পান্ডুয়া হুগলী অন্যতম প্রাচীন জনপদ ও বানিজ্যকেন্দ্র। কিংবদন্তী অনুসারে পান্ডু বা পান্ডুদাস হিন্দু রাজার নাম থেকে পান্ডুয়ার উৎপত্তি। জি.টি রোডের ধারে শাহ সুফীর সুউচ্চ মিনার ও প্রাচীন বড়ি মসজিদ (বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্তপ্রায়) অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে।১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে এটি তৈরি করেন শাহ সুফিউদ্দিন। এখানকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান এটি।
রাধাবিনোদ মন্দির, বীরভূম…
রাধাবিনোদ মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির রূপেও খ্যাত। এই মন্দিরটির মোট ৯টি চূড়া রয়েছে। বোলপুরের কাছে কেন্দুলি গ্রামে এটি অবস্থিত। বীরভূমে এলে এই জায়গাটি দেখতে ভুলবেন না। মন্দির ও আশ্রম পরিবেষ্টিত এই গ্রামটি একটি ধর্মীয় তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে এই স্থানে বাউল মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
ইছাই ঘোষের মন্দির, বর্ধমান…
বর্ধমানের কাঁকসা থানার অধীনে গভীর জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম। অতীতের ‘ঢেকুর’ নাম মুছে গিয়ে বর্তমান নাম গৌরাঙ্গপুর। জনবসতি নেই বললেই চলে। বয়ে গেছে অজয় নদী। ও-পারে কবি জয়দেবের কেন্দুলি, আর এ-পারে শাল-অর্জুন-শিরীষ এবং বুনো গাছগাছালিতে ভরা গা ছমছমে জঙ্গল। এমনই জঙ্গলের মাঝে রয়েছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ এক বিশাল শিবমন্দির। ১০০ফুট উঁচু মন্দিরের গায়ে জীর্ণ টেরাকোটার নকশা আজও বহন করে চলেছে অতীতের স্মৃতি। এই মন্দিরই ইছাই ঘোষের দেউল নামে পরিচিত। এই মন্দিরের বয়স নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন দেউলটি ১৬শ/১৭শ শতকের। তার চেয়ে প্রাচীন নয়। এই দেউল থেকেই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ চলে গেছে ইছাই ঘোষের আরাধ্যা দেবী শ্যামরূপার মন্দিরে। একে বলে শ্যামরূপার গড়। তবে কয়েকটি সিঁড়ি আর মাটির ঢিবি ছাড়া গড়ের আর কোনও চিহ্ন নেই। আর শ্যামরূপার মন্দিরটি নতুন। দেবী এখানেই পূজিতা হন। সপ্তম শতকে ইছাই ঘোষ নামে এক ব্যক্তি এটি তৈরি করেন বলে জানা যায়। এর বাইরে এ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না।
বড় সোনা মসজিদ , গৌড়…
বড় সোনা মসজিদ ভারতের গৌড়ে অবস্থিত মুসলিম যুগের স্থাপত্য নিদর্শন। গৌড়ের সবচেয়ে বড় মসজিদ হল বড় সোনা মসজিদ। এটি হোসেন-শাহ স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। স্থাপনাটি ইটের গাঁথুনি দ্বারা নির্মিত এবং বাইরের অংশ পাথর দ্বারা আবৃত ছিল। গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে ফিরোজপুর গ্রামে সোনালি রঙের আস্তরণ যুক্ত আরেকটি সোনা মসজিদ ছিল। সেটি ছিল আকারে ছোট। তাই এ মসজিদটিকে বলা হত বড় সোনা মসজিদ, আর ফিরোজপুরেরটিকে বলা হত ছোট সোনা মসজিদ। পুরানো রেকর্ড থেকে জানা যায়, এই মসজিদটি মূলত বারদুয়ারী বা বড়দুয়ারী নামে পরিচিত ছিল, অর্থাৎ যে স্থাপনার বারটি দরজা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে মসজিদটির এগারটি দরজা রয়েছে। অপরদিকে, আবিদ আলি বর্ণনা করেছেন, বারদুয়ারী শব্দটির অর্থ সাধারণভাবে বড় হলরুম। মসজিদের সামনে অবস্থিত বড় উদ্যানটির কারণে এই নাম ব্যবহার করা হত।