পথ —– ৩৮
—————–
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
দুয়ারে মাদুর পেতে হ্যারিকেনের আলোয় বসে পড়ছি। মা কাজ সেরে আমার কাছে এসে বসত। হাতে একটা পোস্টকার্ড। “দু’কলম লিখে দে না বাবা” —– বলে পোস্টকার্ডটা আমার পড়ার বইয়ের ওপর এসে রাখত। আমি লিখতে চাইতাম না বলে মা-র কথায় এত বাবা বাছার সুর। আমি মাকে বলতাম, “আমি তুমি হতে পারব না। তার চেয়ে আমি আমার ভাষায় লিখে দি।” আমি জানতাম সেটা হয় না। বড়দি-র শ্বশুরবাড়িতে তো আর আমি চিঠি লিখতে পারি না। সেটা ভালো দেখায় না। এর জন্য আবার দিদিকে কথা শুনতে হবে। আমি নিজে লিখতে চাইলে মা এইসব আশঙ্কার কথাই শোনাত।
প্রথম দিনে কিছুতেই লিখতাম না। অনেক সময় বাবাও লিখে দিত। দিদিও লিখত। যখন কারও সময় হতো না তখন আমি লিখতাম। মা আমার পাশে বসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বলতে শুরু করত। শ্বশুরবাড়ির বাড়ির সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করে, আমাদের কুশল জানিয়ে মা দিদির কথায় ফিরে আসত। দেখতাম এক অসহায় মাকে। মায়ের মুখে অসহায়তার স্পষ্ট ছাপ।
দিদিকে নিয়ে মায়ের কত জিজ্ঞাসা। কিন্তু কিছুই প্রায় বলতে পারত না। কারণ চিঠিটা তো আগে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে গিয়ে পড়বে। তারপর সেটা দিদির হাতে নাও পড়তে পারে। মা এসব কিছুই জানত। কিন্তু তবুও বলতে চাইত। “তুই তো আমাদের কথা ভুলেই গেছিস। একবার আসতে পারিস তো। জামাই সময় না পেলে তুই একাই চলে আসিস” ——- আমার কলম কিন্তু থেমে আছে। এমন কথা কিন্তু চিঠিতে লেখাই যায়। কিন্তু তবুও ক্লাস এইটের একজন ছেলে সংসারী মানুষজনদের সাথে থাকতে থাকতে এটা বেশ ভালোই জেনে গেছে যে, এটা একটা বিয়েওলা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে লেখা যায় না, বিশেষ করে যে মেয়ের স্বামী অর্থনৈতিকভাবে বাবা মায়ের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। মা একসময় নিজেই বলে উঠল, “না, এটা লিখিস না। ওকে তাহলে আবার কষ্ট দেবে।”
মা কত কথা যে বলে যায়, অথচ লেখা হয় তিন লাইন। সবই প্রায় বাদ চলে যায়। খুব কষ্ট পাই মনে মনে। কিন্তু মা বুঝতেও পারে না। মা হয়ত ভাবে, আমি হয়ত চিঠি লিখতে চাই না। কিন্তু এটাই না লেখার একমাত্র কারণ। ওই বয়সে খুব ইচ্ছা করত, দিদির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ওর ওপর অত্যাচারের একটা বিহিত করে আসতে। কিন্তু পারতাম না। আবার চোখের সামনে মায়ের অসহায়তাও আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দিত।
মাকে দেখে মনে হতো, সহ্যের সীমা পার হয়ে যেতে একমাত্র মায়েরাই পারে। আমরা তো একটা কিছু সহ্য করি। বিশেষ একটা দিক আমাদের সামলাতে হয়। আর মায়েরা চতুর্দিক থেকে হাজারো বাধা মুখ বুজে সহ্য করে। কোনোদিন মাকে রেগে যেতে দেখি নি। কষ্ট কষ্ট বুকেও মা মুখে হাসি ধরে রাখত। সত্যিই মা মাটি —– সর্বংসহা।
*****************