দেবদাসী প্রথা হল এমন এক মন্দির সেবিকা প্রথা, যেটিকে বর্ধিত অর্থে মন্দিরের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা প্রথার নামান্তর বলা চলে। এটি এক ধরনের সামাজিক রীতি যেখানে একজন মানুষ নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে যৌন সঙ্গম করে। এ ধরনের কাজে জড়িত মহিলা দেবদাসী বা ধর্মীয় গণিকা বলে পরিচিতি পায়।
অতীতে দেবদাসীদের বলা হত কলাবন্তী যারা শিল্পকর্মে পারদর্শিনী। অভিজাত শ্রেণির দ্বারা তারা মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত হত। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল মন্দিরের মেঝে ঝাড়ু দেওয়া, পবিত্র প্রদীপে তেল ঢালা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পূজামন্ডপে ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় নৃত্যগীত পরিবেশন করা এবং পূজার সময় প্রতিমাকে বাতাস করা। এই কাজের জন্য তাদেরকে মন্দিরের তহবিল থেকে যা প্রদান করা হতো তা তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অপ্রতুল ছিল বলে দৈনন্দিন জীবিকা অর্জনে ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি (Sacred prostitution) করতে তারা বাধ্য থাকত।
কৌটিল্য জানান যে, তখন দেহব্যবসা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রীক। অর্থশাস্ত্রে গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে। তাঁর কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করা । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষের যে চিত্র পাওয়া যায় যা নিয়ে মতদ্বৈধতা আছে ।
কৌটিল্যর দেবদাসী প্রথার বর্ণনায় স্পষ্ট যে, দেবদাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরে সেবিকার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে তাদের এবং বিধবা, পঙ্গু মহিলা, সন্ন্যাসিনী বা ভিখারিনী, পণ পরিশোধে ব্যর্থ মহিলা, গণিকার মা এবং পশম, শণ ইত্যাদি বাছাই-এর কাজে নিয়োজিত মেয়েদের মন্দির উপাধ্যক্ষগণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করত। মানবজাতির বংশবৃদ্ধির জন্য প্রাচীন হিন্দুসমাজে একটি মেয়েকে দেবীমাতার নামে উৎসর্গ করার প্রথা চালু ছিল যেখানে বারোয়ারি হিসাবে তাকে রাখা হত। ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে রাজা, জমিদার ও পুরোহিতদের প্রাধান্য ও ইচ্ছা অনুযায়ী দেবদাসী অর্থাৎ ঈশ্বরের সেবিকা নিয়োগ করা হত। কিন্তু আসলে তাদের ধর্মীয় গোঁড়ামির মোড়কে দেহোপজীবিনী হিসাবেই ব্যবহার করা হত। তাদের নিজস্বতা, স্বকীয়তা বা ইচ্ছা বলতে কিছুই ছিল না।
এক সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে দেবদাসী প্রথা তুলে দিতে কর্ণাটক রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে ‘উৎসর্গ’ করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে, একটি সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ঐ অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন৷ এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৮৮ সালে৷ এখনো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িষায় এবং গুজরাটে দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজে ব্যবহার করা হয়।
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যেখানে চরম দারিদ্র্য, জাতিভেদ, অশিক্ষা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা জড়িত।সারা ভারত জুড়েই দেবদাসী প্রথার চল থাকলেও বিশেষ করে তার আধিপত্য ছিল দাক্ষিণাত্যে। সেখানে রাজারা কোন অনুষ্ঠানে কয়েকশ দেবদাসী দান করতেন মন্দিরে। ইয়েলাম্মা দেবী ছিলেন দেবদাসীদের ঈশ্বর। বৃটিশ সরকারের কাছেও এ প্রথা বিলোপের আবেদন করে অনেকে ‘হিন্দুবিরোধী’ বলে খ্যাত হন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর কিছু রাজ্য আইন করে এই প্রথা বন্ধ করতে চায়।
কিন্তু এই আইন প্রণয়নে পুরানো দেবদাসীরা অত্যন্ত কঠিন সমস্যায় পড়ল। সমাজচ্যুত ও সংসারচ্যুত এই মহিলাদের দৈনন্দিন জীবিকা অর্জনের কথা কেউ ভাবেনি। উপায়ান্তর না পেয়ে সম্পূর্ণ পতিতাবৃত্তিতে অনেকেই নেমে পরে, আবার অনেকে বড়লোকের রক্ষিতা হয়ে রইল।দেবদাসী প্রথার আদিকথা ও এই অসহায়, আশ্রয়চ্যুত মহিলাদের দুরবস্থা নিয়ে ১৯৮৩ সালে নারায়ণ সান্যাল দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন ‘সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম’ ও ‘সুতনুকা কোন দেবদাসীর নাম নয়’ বলে। দক্ষিণ ভারতে ওই মহিলারা উপায়ান্তর না দেখে, এখনও ধর্মের সঙ্গে যোগাযোগ অল্প হলেও কিছুটা সম্মানের আশায় তাঁরা দেবদাসী নাম ব্যবহার করেন।