Home আইন আদালত কর্মস্থলে মহিলাদের যৌন হয়রানি (নিবারণ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবিধান) আইন ২০১৩

কর্মস্থলে মহিলাদের যৌন হয়রানি (নিবারণ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবিধান) আইন ২০১৩

কর্মস্থলে মহিলাদের যৌন হয়রানি (নিবারণ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবিধান) আইন ২০১৩

লেখিকা পরিচিতি ~ সংযুক্তা সেন, প্রখ্যাত আইনজীবী বিধাননগর মহকুমা আদালত ( ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ )  

 

 

কর্মস্থলে মহিলাদের যৌন হয়রানি (নিবারণ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবিধান) আইন ২০১৩

 

বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে মহিলারা শুধু গৃহকর্মে লিপ্ত থাকা নয় পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাহির জগতে পা রেখেছে। সংসারের দায়িত্ব ভাগ করে নিচ্ছে. সে অবস্থায় নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর্মস্থল প্রতিটি মহিলার মৌলিক অধিকার। একজন মহিলার যৌন হেনস্থা মানে তার সম্মান ও সমানাধিকারের ওপর আক্রমণ।

১৯৯৭ সালের আগে কর্মস্থলে মহিলাদের যৌন হয়রানির জন্য কোন নির্দিষ্ট আইন ছিল না, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৪ ধারায় মামলা দায়ের করা হতো  কিন্তু ১৯৯৭ সালে রাজস্থানে ভাঁওড়ী দেবী নামের একজন সরকারি কর্মচারী রাজস্থানের গ্রামে গঞ্জে বাল্য বিবাহ রোধের প্রচেষ্টা করতেন কিন্তু সেই গ্রামের লোকেরা সেটা ভালো চোখে দেখেনি তারা ভাঁওড়ী দেবীকে আটকানোর জন্য তাকে ধর্ষণ করেন এবং আদালত থেকেও দোষীরা কোন শাস্তি পায় না। তখন মহিলাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য একটি সংগঠন গঠিত হয় যার নাম হয় “বিশাখা” তারা ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে সেই মামলায় সর্বোচ্ছ আদালত কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অধিকার ও সুরক্ষার কিছু নির্দেশিকা দেয়, যা “বিশাখা নির্দেশিকা” নাম পরিচিত।

পরবর্তীকালে ভারত সরকার ২০১৩ সালে “কর্মস্থলে মহিলাদের যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবিধান)আইন” প্রনয়ণ করে। এই আইনটি হলো  ১৯৯৭ সালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত “বিশাখা নির্দেশিকা” এর বর্ধিত অংশ। এই আইনের দ্বারা মহিলাদের কর্মস্থলে যৌন হয়রানিকে বেআইনি বলে স্বীকৃত করে এবং তার নিবারণ,  নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবিধান প্রদান করে। কি কি ভাবে কোন মহিলা যৌন হয়রানির শিকার হতে পারে, কিভাবে এই আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পরা যায়, কোথায় অভিযোগ করতে হবে, কিভাবে কর্তৃপক্ষ বিষয় তা নিয়ে তদন্ত ও বিচার করবে সেই নিয়ে এই আইনে আলোচনা করা আছে।  এই আইনটি কেবলমাত্র মহিলাদের জন্য, যারা কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন তবে এর জন্য জরুরি নয় যে সেই মহিলাকে ওই কর্মস্থলে কাজ করতে হবে সে ওই কর্মস্থলে কোন বহিরাগত মহিলাও হতে পারেন। “কর্মস্থলে মহিলাদের যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবিধান)আইনে”  নির্দেশ আছে যে কর্মস্থলে ১০ জনের বেশি মহিলা কর্মচারী থাকলে সেখানে একটি অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে, কোন অভিযোগ না আসলেও কমিটি গঠন করে রাখতে হবে, যাতে যখন কোন মহিলা যৌন হয়রানির শিকার হয় তখন সেই মহিলা যেন অভিযোগ করতে পারে।

অভিযোগকারিণী যে কোন বয়সের বা যেকোন পদাধিকারের হতে পারে। যে কোন কর্মস্থলে চাকুরীরত যেমন স্থায়ী, অস্থায়ী, সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি,  হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্রীড়াপ্রতিষ্ঠান, ইত্যাদি। যেকোন মহিলারাই অভিযোগ করতে পারে যদি সে যৌন হয়রানির শিকার হয়। এমনকি মহিলা গৃহকর্মী, দিনমজুর, বা কারুর কাছে প্রতক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কাজ করে অথবা চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের কাজ করে তারাও  অভিযোগ করতে পারে। শুধু তাই নয় কোন মহিলা কর্মরত থাকা অবস্থায় যদি কোন কাজ বা কর্মস্থল পরিদর্শনের সময় যৌন হয়রানির শিকার হয় তারাও অভিযোগ করতে পারে।

এই আইনে নিয়োগকর্তাদের জন্য কিছু নির্দেশ আছে যেমন মহিলাদের সুস্থ, সুরক্ষিত কাজের পরিবেশ দিতে হবে, তারা যেন যৌন হয়রানির শিকার না হয় তার জন্য মাঝে মঝে সচেতনতা প্রোগ্রাম করতে হবে, অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। যদি কোন নিয়োগকর্তা এই নির্দেশিকা অমান্য করে তবে তার জরিমানাও হতে পারে। সেই কিমিটিতে ওই কর্মস্থলে উচ্চপদে কর্মরত আছে এমন কোন মহিলাকে শীর্ষস্থানে রাখতে হবে। যদি সেই কর্মস্থলে উচ্চপদে কোন মহিলা না থাকে তবে অন্য কোন বিভাগ বা কোন প্রশাসনিক কর্মস্থল থেকে নিয়োগ করতে হবে। কমপক্ষে এমন দুজনকে কমিটিতে সদস্য করতে হবে যারা কোন ভাবে সামাজিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত আছে এবং মহিলা যৌন হয়রানির সম্পর্কে অভিজ্ঞাতা আছে বা আইনের জ্ঞান আছে। একজন এমন সদস্য রাখতে হবে যিনি কোন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে যুক্ত ও অন্যান্য সামাজিক কাজকর্মের অভিজ্ঞাতা আছে। যদি কোন নিয়োগ কর্তার বিভিন্ন কর্মস্থল বা নানা জায়গায় অফিস থাকে তবে সব জায়গায় বা সব কর্মস্থলে একটি করে কমিটি গঠন করে রাখতে হবে। নিয়োগ কর্তারাই সদস্য মনোনীত করবে এবং সমস্ত সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক মহিলা সদস্যা রাখতে হবে। কমিটির সদস্যরা তিন বছরের বেশি কেউ কমিটিতে থাকতে পারবে না। অভিযোগকারিণীকে লিখিতভাবে কমিটির কাছে অভিযোগ জানাতে হবে। অভিযোগ পত্রটিতে যৌন হয়রানি বা হেনস্থার পূর্ণ বিবরণ দিতে হবে, তারিখ, সময়, স্থান, দুপক্ষের কাজের সম্পর্ক, অভিযুক্তের নাম ও ঘটনার বিবরণ সহ জমা করতে হবে অভিযোগপত্র পাবার ৭দিনের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সেই কমিটি একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাবে ও সেটি পাবার ১০দিনের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজের স্বপক্ষে লিখিত ভাবে কমিটিকে জানাবে। অভিযোগ পাবার পর কমিটি সেটি অনুসন্ধান করার, প্রমান ও সাক্ষী গ্রহণ করার অধিকার রাখে। এই অনুসন্ধান ও সাক্ষী গ্রহণ, প্রতিবিধান, সমস্ত পদ্ধতিটি ৯০ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে হবে। এবং একটি প্রতিবেদন জমা করতে হবে কমিটিকে। ঘটনার অনুসন্ধান ও প্রমানের জন্য অভিযোগকারিণী ও অভিযুক্তকে কমিটির সামনে হাজির থাকে নির্দেশ দিতে পারে। এই অনুসন্ধান ও প্রমান সংগ্রহের পদ্ধতিটি গোপনীয় রাখতে হবে যদি কেউ গোপনীয়তা ভঙ্গ করে তবে তার ৫০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। অভিযোগকারিণী যদি শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম হয় তালে তার কোন আত্মীয়, বন্ধু, বা তার ডাক্তার, মনোরোগ বিশেজ্ঞ এই অভিযোগ জমা করতে পারবে। এই অনুসন্ধান চলাকালীন অভিযোগকারিণী ৩মাস পর্যন্ত ছুটি নিতে পারবে, কর্মস্থলের থেকে বদলির আবেদন করতে পারবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অভিযোগকারিণীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখার আবেদন ও করতে পারবে তবে অভিযোগকারিণী কোন আবেদন না করলেও কমিটি সতর্কতা অবলম্বন করে উপরোক্ত নির্দেশগুলি দিতে পারে। দোষ প্রমান হলে সার্ভিস রুল অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করতে পারবে কমিটি। এছাড়াও দোষী ব্যক্তির পদোন্নতি আটকে দিতে পারে, অন্য স্থানে বদলি করে দিতে পারে, অভিযোগকারিণীকে ক্ষতিপূরণ দেবার বিধান দিতে পারে এই কমিটি। কিংবা যদি অভিযোগকারিণী রাজি থাকে তবে দুপক্ষের মধ্যস্থতায় বিষয়টি সমঝোতা করে নিতে পারে। কোন দোষী ব্যক্তি যদি এই বিধান অমান্য করে তবে ওই ব্যক্তির আর্থিক জরিমানাও হতে পারে।

এই আইনের সাফল্য ও প্রকৃত উপযোগিতা ঘটাতে হলে সমাজে এই আইন সম্বন্ধে আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

 

সংযুক্তা সেন

আইনজীবী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here