শিবের উপাসক দের কাছে মহা শিবরাত্রি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। গ্রেগারিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই বছর ১৩ ই ফেব্রুয়ারি শিবরাত্রি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাউথ ইন্ডিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মাঘমাসের শুক্লপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে মহা শিবরাত্রি অনুষ্ঠিত হয়। অপরপক্ষে উত্তর ভারতে ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু উভয় দিনই একইদিনে পর্যবসিত হয় এবং শুধুমাত্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।
ভগবান শিব ত্রিমূর্তি অর্থাৎ ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মধ্যে ধ্বংসাত্মক দেবতা হিসাবে খ্যাত। কিন্তু ভগবান শিব শুধুমাত্র ধ্বংসের দেবতা হিসাবে বিখ্যাত এই কথা সঠিক নয়। আধ্যাত্মিক যোগের মাধ্যমে সকল দিকে তাঁর ব্যুৎপত্তি এবং তিনি সকল দেবতার থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। কারণ যেখানে মানুষ ধ্বংসই শুধু খুঁজে বেড়ায়, সেই শ্মশান ভূমির ছাই মেখে তিনি বিশ্ব প্রতিপালন করেন। নটরাজ রূপে তিনি বিধ্বংসী নৃত্য পরিবেশন করেন আবার তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে নির্গত রশ্মির মাধ্যমে ধ্বংসলীলা ও সংহারকার্য সম্পন্ন করেন। একাধারে তিনি উমাপতি হিসাবে প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীক অন্যদিকে বন্যপ্রাণী ও সাপের মধ্যে তিনি বাস করেন। ভগবান শিবের সম্পর্কে এমন প্রচুর ঘটনা ও কাহিনী প্রচলিত আছে যা তাঁর ভক্তরাও সম্পূর্ণভাবে জানেনা। আজ আমরা এই সকল কাহিনীর মধ্যে কিছু কাহিনী আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি।
কালীর পদমূলে ভগবান শিব–
দেবী কালীর পায়ের তলায় যখন আপনি ভগবান শিবের মূর্তি দেখেন, তখন অবশ্যই লক্ষ্য করবেন স্বয়ং শিবের মুখে একটি স্মিতহাসি রয়েছে। শিবকে সর্বদাই অত্যন্ত রাগী এবং গম্ভীর প্রকৃতির বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কথিত আছে দেবী দুর্গার অংশ হিসাবে দেবী কালীর আবির্ভাব হয় রক্তবীজ নামক অসুরকে ধ্বংস করার জন্য। রক্তবীজ বধের পর দেবী কালী শান্ত মূর্তিতে এসে পৌঁছাননি। তখন মহাদেবীর রুদ্রমূর্তিতে দেবতা ও অসুরগণ অত্যন্ত ভয়ে ভীত ও বিচলিত হয়ে পরেন। তারা স্বয়ং ভগবান শিবের কাছে এসে তাকে অনুরোধ করেন যাতে ভগবান শিব দেবীর রুদ্রমূর্তি প্রশমন করেন। শিব বুঝতে পারেন যে সেই অবস্থায় দেবী কালীকে থামানো অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তিনি ভগবতীর সংহার রূপের সামনে শুয়ে পরেন। দেবী কালী যখন অসুর দমন করতে করতে এগিয়ে চলেন তখন স্বয়ং শিবের ওপর তিনি উঠে পড়েন এবং নিচে তাকিয়ে তাঁর স্বামীকে স্মিত হাস্যে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেন। তখন তাঁর রাগের প্রশমন হয় এবং তিনি তার ভুল বুঝে জিভ কাটেন। সেই থেকে মা কালীর জিভ সর্বদা মুখের বাইরে এবং তিনি স্বয়ং শিবের উপর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পূজিতা হন।
মহাবীর হনুমান হিসাবে ভগবান শিব–
হনুমান কে অনেক সময় রুদ্র অবতার বলা হয়। তার কারণ, ভগবান হনুমানকে শিবের অংশ হিসাবে মনে করা হয়। কথিত আছে ভগবান শিবের অংশ বাতাসের দেবতা দ্বারা রানী অঞ্জনার গর্ভে স্থাপিত হয় এবং তিনি হনুমানের মাতা হিসাবে পরিচিত হন। শিব স্বয়ং চেয়েছিলেন যাতে তিনি ভগবান বিষ্ণুর সেবা করতে পারেন কিন্তু নিজের রূপে এটা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি হনুমান হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্রের সেবা করেছিলেন। হনুমানের সেবা এতটাই হৃদয়গ্রাহ্য ছিল যে রামচন্দ্র এবং মহাবীর হনুমানের পুজো একসাথে করা হয় এবং মহাবীর হনুমান ছাড়া রামচন্দ্র অসম্পূর্ণ।
অমরনাথ গুহার কাহিনী—
সমগ্র দুনিয়ার কাছে অমরনাথ গুহা একটি অন্যতম বিস্ময়কর এবং আশ্চর্যজনক স্থান। এই স্থানে শিবলিঙ্গ নিজের থেকেই তৈরি হয় বরফ দ্বারা। এই গুহাটির বর্ণনা অত্যন্ত বিস্ময়কর। কিভাবে এখানে এই বরফের শিবলিঙ্গ তৈরি হয় তা সত্যিই খুঁজে বের করা আজও সম্ভব হয়নি।কথিত আছে, দেবী পার্বতী ভগবান শিবকে গুপ্তভাবে তাঁর অমরত্বের কথা জানতে চেয়েছিলেন। শিব পার্বতীকে অমরনাথ গুহায় নিয়ে যান যেখানে এই অমর কথা শোনার জন্য কেউ ছিলনা। বলা হয়, হরিণের চামড়ার ওপর তিনি বসে ছিলেন এবং তার অমরত্ত্বের গোপনীয়তার কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন। সেই সময় সেই হরিণের চামড়ার উপরে এক জোড়া পায়রা ডিম পেরেছিল যেগুলি ফুটে পরে বাচ্চা হয় এবং বলা হয় এই পায়রাগুলি অমরত্ব লাভ করেছে। এমনকি বর্তমানেও সমস্ত ভক্তরা ভগবান অমরনাথের গুহায় পৌঁছলে এই পায়রা জোড়াকে দেখতে পান বলে বর্ণনা করেন। এই গুহাটি ইতিহাসের অধ্যায় থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
এক সময় কাশ্মীর উপত্যকায় এক বিপুল বন্যা সৃষ্টি হয়। মহর্ষি কাশ্যপ এই বন্যার জলকে বিভিন্ন নদী এবং ঝর্ণায় পর্যবসিত করেন মহর্ষি ভৃগু অমরনাথ গুহার রাস্তা খুঁজে বের করেন। যখন এই গুহা আবার হারিয়ে গিয়েছিল, অকস্মাৎ একদিন এক রাখাল যে ভেড়া চড়াতে গিয়ে এই গুহা আবিষ্কার করে এখানে সে এক সন্ন্যাসীরর দেখা পায় যে তাকে এক ব্যাগ ভর্তি কয়লা উপহার দিয়েছিল। যখন সেই রাখাল বাড়ি ফিরে আসে সে লক্ষ্য করে ঐ ব্যাগভর্তি কয়লা সোনায় পরিণত হয়েছে। রাখাল আবার সেই গুহায় ফিরে যায় সন্ন্যাসীকে খুঁজতে কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পায় না কিন্তু সেখানে বরফ দিয়ে তৈরি শিবলিঙ্গ খুঁজে পায়। সেই থেকে অমরনাথ গুহায় বছরের পর বছর ভক্তরা ভগবান শিবের পুজো করে আসছেন এবং মন থেকে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।
ভগবান শিবের সাথে নন্দীর সম্পর্ক স্থাপন–
পুরাণে বর্ণিত একদা গোমাতা সুরভী প্রচুর সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর দ্বারা নিঃসরিত দুগ্ধ বন্যা হয়ে ভগবান শিবের বাসগৃহ ভাসিয়ে দিয়েছিল যার জন্য ভগবান শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। আর এই ক্রোধ দমনের জন্য দেবী সুরভী তাঁর পুত্র নন্দীকে ভগবান শিবের কাছে দান করেছিলেন। ভগবান শিব অত্যন্ত খুশি মনে নন্দীকে গ্রহণ করেন এবং ভগবান শিবের সাথে নন্দী সম্পৃক্ত অবস্থায় তখন থেকেই সর্বত্র বিরাজমান। কথিত আছে নন্দীর কানে যদি নিজের মনষ্কামনা জানানো হয় তাহলে তিনি সেই মনষ্কামনা ভগবান শিবের দ্বারা পূরণ করার জন্য অবশ্যই সাহায্য করেন।
ভগবান বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র ভগবান শিবের কাছ থেকে প্রাপ্ত হন—-
একবার ভগবান বিষ্ণু হাজার পদ্ম দ্বারা ভগবান শিবের পূজা করেছিলেন। তাঁর ভক্তি দেখার জন্য ভগবান শিব গোপনে একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। যখন শেষতম পদ্ম দান করবার সময় আসে, তখন ভগবান বিষ্ণু লক্ষ করেন যে শেষতম পদ্মটি সেখানে অদ্ভুতভাবে অনুপস্থিত।তিনি তাঁর পূজা ব্যর্থ হতে দিতে চাননি। তাই পদ্মের পরিবর্তে তিনি নিজের একটি চক্ষু ভগবান শিবকে পূজায় পদ্ম হিসাবে দান করবার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁকে কমলনয়ন বলা হত শুধু এই কারণে নয় যে তাঁর চক্ষুদুটি পদ্মের পাপড়ির ন্যয় ছিল বরং এই কারণেও যে তিনি তার চক্ষু দুটি পদ্মফুলের পরিবর্তে ভগবান শিবের পূজায় উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এই ঘটনা ভগবান শিবকে অত্যন্ত মুগ্ধ করে এবং তিনি ভগবান বিষ্ণুকে সুদর্শন চক্র উপহার দেন।
ভগবান শিবের গায়ে ভস্ম মাখার কারণ—
একদা এক অত্যন্ত ধার্মিক সাধু বসবাস করত এবং পূজার্চনা করত সে শুধুমাত্র শাকসবজি খেয়ে দিন যাপন করত অর্থাৎ শাকাহারী ছিল। একবার গাছ কাটার সময় তার পূজার জন্য, সে নিজের আঙুল কেটে ফেলে আর অবাক হয়ে লক্ষ্য করে রক্ত বেরোনোর পরিবর্তে তার আঙুল জুড়ে যায়। সেই সাধু অত্যন্ত খুশি হয় এবং একে তার নিজের সারা জীবনের সাধনা ও তপস্যার ফল হিসাবে গ্রহণ করে। সে অত্যন্ত খুশি মনে নাচতে গাইতে থাকে এবং পৃথিবীতে নিজেকে সর্বাপেক্ষা ধার্মিক বলে মনে করে।
সেই সময় সেই জায়গায় ভগবান শিব একজন বৃদ্ধ সন্যাসীর ছদ্মবেশে এসে উপস্থিত হন এবং তিনি সেই সাধুকে নিজের আনন্দের কারণ জিজ্ঞাসা করেন।যখন তিনি কারণ জানতে পারেন, তখন ভগবান শিব সেই সাধুকে বলেন যে প্রত্যেকটি জিনিস মৃত্যুমুখী হয় এবং সে ভস্মে রূপান্তরিত হয়। তাই তিনি যত ধার্মিকই হোন না কেন তার শেষ পরিণতি হলো এক মুঠো ভস্ম। এই বলে তিনি তাঁর নিজের আঙুল কেটে দেন।
অত্যন্ত অবাক হয়ে সেই সাধু লক্ষ্য করেন যে সেই আঙুলের ভেতর থেকে ভস্ম নির্গত হচ্ছে। সাধুর অহঙ্কার চূর্ণ হয় এবং তিনি বুঝতে পারেন যে এটি স্বয়ং ভগবান শিব ছিলেন যিনি তাকে শিক্ষা দেবার জন্য নিজেই সামনে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই দিন থেকে ভগবান শিবের সর্বাঙ্গ ভস্মাবৃত থাকতে দেখা যায়। মৃত্যু জীবনের চরম সত্যকে ঘোষণা করে। তাই যা হবার হবে অর্থাৎ একদিন সবকিছুই ভস্মে রূপান্তরিত হবে।
পার্বতীর পরীক্ষা–
পুরানে বর্ণিত আছে দেবী পার্বতী বহু বৎসর সাধনা এবং তপস্যা দ্বারা ভগবান শিবের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাকে বিবাহ করার জন্য। একটি কাহিনী প্রচলিত আছে যে ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতীর বিবাহের পূর্বে শিব একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির বেশে এসে দেবী পার্বতীকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ভগবান শিবকে বিবাহ করার জন্য মুর্খামি করা দেবী পার্বতীর শোভা পায় না। তিনি আরো বলেছিলেন ভগবান শিব একজন ভিখারীর জীবন যাপন করেন এবং সুন্দর ও সুখী জীবন দেবার মতন কোন উপকরণই তিনি দেবী পার্বতী কে দিতে পারবেন না।
এই সকল কথা দেবী পার্বতীকে অত্যন্ত বিচলিত এবং ক্রুদ্ধ করে তোলে। তিনি সেই বৃদ্ধ ব্যক্তিকে সেখান থেকে প্রস্থান করতে বলেন এবং তাকে বলেন যে তিনি ভগবান শিব ছাড়া অন্য কাউকে বিবাহ করবেন না। এই কথা শুনে শিব তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করেন এবং পার্বতীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।