“কালা জাদুর” কিছু বাস্তব রূপ…

ওয়েব ডেস্কঃ   একটিও শনিবার বাদ যায়না যেই দিন না ভাণ্ডারী বাবু ওনার দোকানে লেবু কাঁচা লঙ্কার মালা লাগান না। বরাবর দেখে আসছি, ওনার এই সবে খুব বিশ্বাস, আরও অবাক হলাম সেই দিন ওনার গৃহ প্রবেশের অনুষ্ঠানে গিয়ে। সুন্দর ঝকঝকে নতুন দোতলা বাড়ী, কিন্তু বাড়ীর সদর দরজার উপরেই লাগানো এক ভয়ঙ্কর কালো রঙের ভূত বা রাক্ষসের মুখ। তার ঠিক নীচেই এককোণে ঝুলানো রয়েছে ছোট একটি কালো ভয়ঙ্কর পুতুল। এত নামীদামী বড় ব্যবসায়ী ব্যক্তি ওনার ছেলে আবার বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার, এর পরেও এই সব নিয়ে অন্ধবিশ্বাস! অবাক লাগলো আমার কাছে। কথায় কথায় বলে ফেললাম ভাণ্ডারী বাবু কে, ‘আপনি পড়ালেখা জানা এত বড় একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এরপরেও এইসব বিশ্বাস করছেন? আর এই কালো রঙের পুতুলটাই বা কি?’ এর প্রত্যুতরে উনি যা বললেন সেটা ওনার মত মানুষের কাছ থেকে শোনা আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ব্যপার। পুতুলটি নাকি তান্ত্রিক থেকে আনা জাদু পরা পুতুল, এতে কোন আজেবাজে নজর ওনার বাড়ীর উপর পরবে না অথবা কোন অলৌকিক শক্তিও প্রবেশ করতে পারবে না। এ আবার কোন ধরনের বিশ্বাস রে বাবা !! সোজা জানতে চাইলাম এই সব ‘জাদু পরা’ তে একজন পড়ালেখা জানা ব্যক্তি কি করে বিশ্বাস করতে পারেন ! এর জবাবে ওনার কথাটা শুনে বেশ খেপে গেলাম আমি। উনি যা বললেন তা হল ” আপ লোগো কি বাঙ্গালমে হি হুয়া হে ইয়ে কালা জাদু কা আবিস্কার, আপ কো নেহি পাতা, বাঙ্গালি হ কর ভি নেহি মানতে হ” …কথাগুলি আমার কাছে বিদ্রুপের সুরের মত লাগলো কিছুটা অপমানের মত। সত্যিই কি এই সব Black Magic বা কালা জাদু র সৃষ্টি আমাদের পশ্চিম বাঙ্গালে ! সেই থেকেই মাথায় চেপে বসল Black Magic সম্বধিত সব তথ্য জানার।

 

কালা জাদু নাম শোনা মাত্র অধিকাংশ লোকেদের মনে ভারতের বাঙ্গাল রাজ্যটাই আসে, কারন এইসব তন্ত্র সাধনা বা তান্ত্রিকরা বারানাসি বা বাঙ্গালের শশ্মানেই সাধনা করে থাকেন। কিন্তু আপনারা এটা জেনে অবাক হবেন যে এই Black Magic বা কালা জাদুর উৎপত্তি আফ্রিকাতে হয়, ভারতের তুলনায় আফ্রিকাতে এর বেশী চল। আফ্রিকাতে কালা জাদু “বুডু”(voodoo) নামে পরিচিত। জন্তু জানোয়ারের শরীরের অংশ বা কালো পুতুল দিয়ে করা হয়ে থাকে এইসব জাদু টোনা। যা বছর বছর ধরে চলে আসছে, কিন্তু সাধারণ লোকেদের কাছে আজও এই বিদ্যা রহস্যময়। আসুন জেনে নেই এর প্রকৃত উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য।

 

প্রায় ১৮৪৭ সালে আফ্রিকাতে এরজুলি দেন্তর নামে “বুডু” দেবী একটি গাছে অবতারিত হন, সৌন্দর্য ও প্রেমের দেবীর প্রতীক ছিলেন এই দেবী। নিজের জাদু দ্বারা উনি জন সাধারণের রোগ ও সমস্যার নিরাময় করতে থাকেন। কিন্তু এক ক্যাথলিক পাদ্রি এইসব সহ্য করতে পারেন নি আর উনি ঐ গাছটিকে কেটে ফেলার আদেশ দেন। সেই থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা বুডু দেবীর মূর্তি বানিয়ে ওনার মন্ত্র দ্বারা তন্ত্র সাধনা করতে থাকেন। বিজ্ঞান অনুসারে এ খুবই দুর্লভ প্রক্রিয়া যা এক বিশেষ পরিস্থিতিতে পরিণাম দেওয়া হয়। মাত্র কিছু সংখ্যক উচ্চস্তরের বিশেষজ্ঞরাই এই প্রক্রিয়া করতে সক্ষম হয়ে থাকেন। ঠিক পুতুলের মত দেখতে মূর্তি ব্যবহৃত হয়, যা কিছু খাদ্য দ্রব্য যেমন, বেসন বা উরদ ডালের আটা দিয়ে বানানো হয়। এক বিশেষ মন্ত্র উচ্চারন দ্বারা এতে জীবন দেওয়া হয়ে থাকে। এরপর যেই ব্যক্তির উপর জাদু করতে হবে তার নাম নিয়ে পুতুলটাকে জাগ্রিত করা হয়ে থাকে।

বুডুতে প্রধানত জন্তু জানোয়ারের শরীরের অংশ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। জানোয়ারের অঙ্গ দ্বারা সমস্যা সমাধানের দাবী করা হয়ে থাকে। এই জাদু দ্বারা পূর্ব পুরুষের আত্মা যেকোনো শরীরে প্রবেশ করে নিজের কার্য সিদ্ধি করতে পারে। মানুষের রোগ কষ্টের নিরাময়েও এই বুডু পুতুলের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বুডু প্রক্রিয়া জানা বিশেষজ্ঞদের মতে এই জগতের সব জীবদের রয়েছে নিজস্ব আত্ম শক্তি, আর এই উরজা কে ব্যবহার করে রোগ নিরাময় করা যায়। বুডুতে বিভিন্ন জন্তুর, যেমন মুরগ, বানর, উট, ছাগল, কুমীর, টিকটিকি, র অঙ্গ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

 

আসলে ‘কালা জাদু’ জিনিসটা কি ! বিশেষজ্ঞদের মতে এ হচ্ছে এক banch of energy। যা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অথবা এক ব্যক্তি দ্বারা অন্য ব্যক্তিতে পাঠানো যায়। একে ‘Law of Conservation of Energy’ দ্বারা জানা যেতে পারে। যা হচ্ছে, কোন আত্ম শক্তি বা এনার্জি যা না সৃষ্টি করা যায় না ধ্বংস করা যায়, শুধু এর স্বরূপ কে অন্য স্বরূপে বদল করা যায়। এটা জানা উচিত এই এনার্জি হল এক ‘আত্ম শক্তি’ যা না কোন দৈবীয় হয় না কোন শয়তানী। তাই এটা মানুষের উপর নির্ভর করে এই শক্তিকে কোন মঙ্গলের কাজে লাগাবে না কোন অপকাজে।
তবে কেনই বা করা হয়ে থাকে এই রকম কোন জাদু !! বিশেষজ্ঞরা এটা মনে করেন যে পুতুলের দ্বারা কোন ব্যক্তির ক্ষতি করা এই জাদুর উদ্দেশ্য নয়। ও এই জাদুকে ‘কালা জাদু’ বলাও ভুল। প্রকৃত অর্থে এ তন্ত্র বিদ্যার এক অংশ। প্রাচীনকালে এমন পুতুলের ব্যবহার দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত কোন রোগীর রোগ নিরাময়ের জন্য করা হয়ে থাকত। পুতুলটির মধ্যে রোগীর চুল বেঁধে এক বিশেষ মন্ত্র দ্বারা নামের সাথে সাথে পুতুলটিকে জাগ্রিত করা হত। এরপর রোগীর যেই অংশে সমস্যা হত পুতুলের সেই অংশে সুঁই ঢুকিয়ে বিশেষজ্ঞ নিজের পজেটিভ আত্ম শক্তিকে ওখানে পৌঁছাতেন। খানিক সময় বাদে ব্যথার উপশমও হত। আর এই কারনেই একে রেকি ও একুপ্রেসারের মিশ্রণও বলা হয়ে থাকে। যাতে নিজের আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে যে কেউকে জীবন দেওয়া যেত।
কিন্তু কিছু স্বার্থপর মানুষ এই প্রাচীন বিদ্যাকে সমাজের সামনে অপসংস্কার রূপে স্থাপিত করেন। যেই ভাবে নিজের পজেটিভ আত্ম শক্তির দ্বারা কোন রোগ নিরাময় করা যায় ঠিক তেমনি সুঁই এর মাধ্যমে নিজের নেগেটিভ শক্তি দ্বারাও কাউকে কষ্ট দেওয়া যেতে পারে। প্রেমে অসফলতা, সন্তানের চাহিদা,ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিহিংসার জেরে লোকেরা ভুল পথে ক্রমশ এগোতে থাকে আর সেই সুযোগে কিছু কিছু ভণ্ড সম্প্রদায় জনসাধারণের দুর্বল মানসিকতার ফায়দা উঠাতে থাকে।

রয়েছে ভারতবর্ষের এমন কিছু জায়গা যেখানে আজও প্রতিনিয়ত চলছে কালা জাদুর ব্যবহার…………
সুলতানশশী, হাইদ্রাবাদ ……এই স্থানটিকে কালা জাদুর আড্ডা বলা হয়ে থাকে। এখানে এমন কিছু কালা জাদুর বাবারা থাকেন যারা বিবাহের পর দাম্পত্যজীবনের অসুবিধে দূর করার অছিলায় মহিলাদের সাথে যৌন সঙ্গম করে থাকেন। কালা জাদু করা মহিলারাও রয়েছেন এখানে। সুলতানশশী তে রয়েছে কিছু লজ যেখানে প্রক্যাশেই চলে কালা জাদুর প্র্যাকটিস। এতসব কিছুর পরেও অন্ধপ্রদেশে কালা জাদু দমনের কোন আইন নেই।

মঘুলপুরা, ছতরিঙ্কা – শাহিলবন্দা, পুরানো হাইদ্রাবাদ……পুরানো হাইদ্রাবাদের এই জায়গা অন্ধবিশ্বাস ও কালা জাদুর মত ইলিগেল একটিভিটিজের জন্য প্রসিদ্ধ। লোকেরা কালা জাদুকে প্রফেশন বানিয়ে নেয়। জনসাধারণের ভাবনার সাথে খেলা হয়ে থাকে। ভণ্ডরা দাবী করে থাকে ছোট মেয়েদের পুতুলের সাথে বিবাহ দিলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

বারানসির শশ্মান, উত্তর প্রদেশ…… বারানসিতে কালা জাদু করা তান্ত্রিক সাধুদের ‘অঘোরী’ বলা হয়ে থাকে। এখানের শশ্মান ঘাটে এরা তন্ত্র সাধনা করে থাকেন। ভগবান শিব ও মা কালী কে সন্তুষ্ট করে তন্ত্র সাধনায় আরও পাওয়ার ফুল হবার জন্য এরা এইসব করে থাকেন।

নিমতলা ঘাট, কোলকাতা…………কোলকাতার নিমতলা ঘাটে কালা জাদু করার সংকেত পাওয়া গেছে। রাত্রিবেলায় অঘোরী বাবারা এসে এখানে কালা জাদুর প্র্যাকটিস করে থাকেন। এখানের শশ্মানে গভীর রাতে চিতা জ্বলার পর চিতা থেকে অবশিষ্ট মাংস গুলিকে এনে তা ভক্ষণ করে, এমনটা করায় নাকি শক্তি অর্জন হয়।

মেঔঙ্গ, আসাম (Mayong, Assam)………আসামের মেঔঙ্গ গ্রামকে কালা জাদুর মূল জড় মানা হয়ে থাকে। এমনকি আশেপাশের গ্রামবাসীরাও এই গ্রামের নাম নিতে ভয় পায়। গুবাহাটি থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত এই গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে নাকি কালা জাদু হয়ে থাকে। দূর দূর থেকে লোকেরা এখানে কালা জাদু শেখার জন্য আসে। এখানে শিব, পার্বতী ও গণেশের তান্ত্রিক প্রতিমা রয়েছে, প্রাচীন কালে দেওয়া হত নরবলি। লোকেদের মতে এখানে আসার পর সবাই রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যায় বা জানোয়ারে রূপান্তর হয়ে যায়।
কুশাভদ্রা নদী, উড়িষ্যা………উড়িষ্যার কুশাভদ্রা নদীর কিনারে কালা জাদু করা হয়ে থাকে। এখানে সাধারণ জনগণের উপর ভণ্ড বাবাদের দ্বারা আক্রমণের খবরও পাওয়া যায়, কিন্তু পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে কাউর হদিস পান নি। এখানে ২০ এরও বেশী নর কঙ্কাল ও হাড় পাওয়া যায়। এছাড়াও জন্তু জানোয়ারের হাড় ও মাংসের টুকরো পাওয়া যায়।

উল্ল্যেখিত লেখন কিছু তথ্য হিসেবে দেওয়া হয়েছে, তার মানে এই নয় যে কোন অন্ধবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। “গীতা” তে অর্জুন ভগবান কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছিলেন যে শ্রী কৃষ্ণের মতে জগতের সবকিছু যদি একই শক্তির থেকে সৃষ্টি ও সবকিছুই যদি দৈবীয় হয়, আর সেই দৈবীয় যদি দূরযোধনের মধ্যেও থাকে, তবে সে কেন এমন অপকাজ করছেন ? শ্রী কৃষ্ণ এর প্রত্যুতরে বলেন, ‘ ঈশ্বর নির্গুণ, দেবত্ব নির্গুণ এর কোন নিজস্ব গুন নেই’। মানে এই যে ঈশ্বর হচ্ছেন এক বিশুদ্ধ শক্তি। এটা জীবের উপর নির্ভর করে একে কোন শক্তি রূপে নেবেন। যেই বাঘ আপনাকে খেতে আসে তার মধ্যেও রয়েছে সেই শক্তি আবার যে আসে আপনাকে বাঁচাতে তার মধ্যেও রয়েছে সেই শক্তি। আমাদের সকলের উপর নির্ভর করে সমাজকে আমরা কোন পথে নিয়ে যাব।।

Recent Posts

CPM leader arrest with money: ভোটের মধ্যে সীমান্তে প্রচুর বাংলাদেশি মুদ্রা সহ ধৃত CPM নেতা, শাস্তির দাবি TMC-র

সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে গরু পাচার বা সোনা পাচারের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এবার সীমান্তে প্রচুর…

9 mins ago

Hotel owner beaten: হোটেল থেকে AC-র রিমোট, চাবি চুরির চেষ্টা, বাধা দেওয়ায় তারাপীঠে আক্রান্ত মালিক

টাকা বা সোনা নয়, এসির রিমোট, চাবি চুরির চেষ্টা, তাও আবার একটি হোটেল থেকে। আর…

38 mins ago

২৫ দিন পর বাড়ি ফিরে এলেন ‘তারক মেহতা…’র ‘নিখোঁজ’ অভিনেতা গুরুচরণ সিং

ডেস্ক: দিনপঁচিশেক ‘বেপাত্তা’ পর বাড়ি ফিরে এলেন হিন্দি সিরিয়ালের অভিনেতা গুরুচরণ সিং। জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘তারক…

51 mins ago

Illegal construction: বেআইনি নির্মাণ কীভাবে রুখতে হবে? সব পুরসভাকে পুস্তিকা পাঠাল পুর দফতর

গার্ডেনরিচ কাণ্ডের পরে একাধিক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কলকাতা পুরসভা। তবে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ শুধু…

1 hour ago

মেট্রোর কাজের জেরে ময়দানে গাছ নিধনের বিকল্প কী?‌ মঙ্গলবার রায়ের সম্ভাবনা কলকাতা হাইকোর্টে

এই বছর প্রবল গরম পড়েছে। সেই গরম থেকে এখনও পুরোপুরি নিস্তার মেলেনি। তখন পরিবেশবিদ থেকে…

2 hours ago

Cyclone Remal: ক্রমশ কাছে আসছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল, পণ্ড হতে পারে রাজ্যের ষষ্ঠ দফার ভোটগ্রহণ

পিনাকী ভট্টাচার্যরাজ্যে লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ যখন মধ্যগগনে তখন বঙ্গোপসাগরে ঘনাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়। মে মাসের শেষে এই…

3 hours ago