পথ —— ২১
—————–
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেনেপুকুর এমন একটা জায়গায় ছিল যেখানে চারপাশে কোনো বাড়িঘর ছিল না। তাই এই জায়গাটা আমাকে একটা আলাদা তৃপ্তি এনে দিত। যেন মনে হতো সভ্যতা থেকে কত দূরে। যখন এখানে এসে পড়তাম, মনে হত আমার সাথে যেন কারও কোনো যোগাযোগ নেই। এই যে আজকের সময়ে এসে এত মানুষের সাথে আমার যোগাযোগ, কিন্তু কারও সম্পর্কেই আমি কৌতূহলী নই, আমার কাছের লোকেরা যখন যা বলেছে সাধ্যমতো করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কখনও তার হাঁড়ির খবর নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি নি ——— সেটা এইভাবে দিনের পর দিন একা থাকার কারণে। প্রকৃতির মাঝে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর কারণে।
বৈশাখের প্রখর রোদে যখন বাগানে বসে থাকতাম তখন পথের দিকে চেয়ে একটা কথাই মনে হতো ——- কিসের প্রয়োজন পুঁথিগত বিদ্যায়। ভীষণভাবে অপ্রয়োজনীয় মনে হতো এই লেখাপড়ার কাজকে।
এমন কত দিন গেছে, একটা লাইনও পড়তে পারিনি। শশ্মানে মড়া পুড়ছে আর আমি দূর থেকে সেই আগুনের দিকে চেয়ে বসে আছি। বাবা মায়ের শেষ জীবনের কথা ভেবে কষ্ট পেয়েছি। কখনও ভাবতে পারতাম না আমার বাবা মা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। ভীষণ কষ্ট হতো। কখনও কাঁদতাম।
একদিন দেখি বাবা বাগানে এসে হাজির। হ্যাঁ, ওই একদিনই। আমার পাশে এসে বসল। বাবার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, কোনোদিন আমাকে পড়ার কথা বলত না। জানতেও চাইতো না আমি কি পড়ছি। একদিন বাবাকে তার এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছে, আমি কোন ক্লাসে পড়ি। বাবা অনেক ভেবে উত্তর দিয়েছিল ক্লাস টেন। কিন্তু আমি তখন মাধ্যমিক শেষ করে ইলেভেনে পড়ছি।
“এটা তো পড়ার জায়গা নয়। তুই এখানে কি করে পড়ছিস?” —— আর কিছু বলল না। সারা বাগানটা একবার ঘুরে বাড়ি চলে গেল।
পরে অনেক ভেবে দেখেছি, এটা সত্যিই পড়ার জায়গা নয়। এই জায়গা তো মানুষকে বাস্তববাদী হতে শেখাবে না। আমাকেও শেখায় নি। অনেক কষ্ট করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেই তবে কিছু বিদ্যা অর্জন করতে পেরেছি। মাত্র একুশ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে যে বেড়িয়ে আসি তার প্রধান মদতদাতা এই বাগান। এই বেনেপুকুরের বাগানই একদিন আমাকে কাঁধে ঝোলা দিয়ে বলেছিল —— আর নয়। অনেক হয়েছে। এবার বেরিয়ে পড়। বাগানের সেই মন্ত্র কানে নিয়ে আমি আজও ঘুরে চলেছি।
হরিৎ~ 17/6/2017
********************