পথ --- ৪ ------------- হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আজও গ্রীষ্মের ছোঁয়ায় শরীর পাতলে বাবা মা-র কথা খুব মনে পড়ে। মাঝরাতে দুয়ার জুড়ে চারজন। প্রত্যেকের হাতেই একটা করে তালপাখা। গ্রামের চারপাশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে রাতপাখিদের ডানা ঝাপটানো। গ্রীষ্মের দিনগুলো ছাড়া এমন দৃশ্যকে প্রত্যক্ষের সুযোগ আর কোথায়? ঘরের থেকে বাইরে বেশ একটা ঠান্ডার আভাস। গরম শরীরে হাতপাখার হাওয়ার ঠান্ডা আদর। তাই কষ্টের বাতাবরণের মধ্যে একটা ভালো লাগা বোধও মনের কোথাও ছড়িয়ে যেত। জ্যোৎস্না রাতে ছিল আর এক মজা। চারপাশের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেতাম। জ্যোৎস্নার চাদর আমার চিরচেনা জগতকে এক অদ্ভুত রহস্যময়তায় মুড়ে দিত। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা ভাঙা ঠাকুরবাড়ি ছিল। জ্যোৎস্নার আলোয় তাকে মনে হতো কোনো ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজার ছেড়ে যাওয়া প্রাসাদ। কালের গর্ভে তলিয়ে গিয়েও এখনও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। বাবার পেশা ছিল যজমানি। কত দূর দূর গ্রামে বাবার সঙ্গে যেতাম। যজমানের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়াতে যেত বাবা। আমাকে সঙ্গে নিত। আমি তখন ক্লাস সেভেন এইটে পড়ি। সেইসময় বাংলার কত গ্রাম যে ঘুরেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। অনুষ্ঠান বাড়ি মানেই জিভের স্বাদবদল। অভাবের সংসারে অনুষ্ঠান বাড়ির দিকে নজর থাকা তাই খুবই স্বাভাবিক। ভোজনরসিক আমি কোনোকালেই ছিলাম না। গ্রামে জন্মে, দীর্ঘসময় গ্রামে কাটিয়েও গ্রাম দেখার নেশা আমার আজও গেল না। গ্রাম দেখবো ----- এই নেশাতেই বাবার সঙ্গে নিজেকে ছুটিয়েছি। বিয়ে দেওয়া শেষ হলে বাবা কিছু মুখে দিয়েই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। ঘড়িতে কোনোদিন দেখতাম রাত দুটো, কোনোদিন রাত আড়াইটে। বাবার হাত ধরে ধূলোর রাস্তায়। গ্রামের রাস্তার ধূলো। গোড়ালি ডুবে যায়। আমার পায়ে হাওয়াই চপ্পল। বাবার গলায় নারায়ণ শিলা বাঁধা, তাই খালি পা। পুকুর থেকে ব্যাঙ ডাকছে। পেঁচার ডাক। কোনো গাছের নিচে দিয়ে আসছি, সামনে পাকা আম এসে পড়ল। কোনো কোনো গাছে অদ্ভুত অদ্ভুত পাখির ডাক। বাবার হাতে হ্যারিকেন। অন্ধকার প্রকৃতির অসাধারণ আবহসঙ্গীতের মাঝে আমরা দুজন। দেখি অনেক দূরে কতগুলো ছোট ছোট আলো। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসতে দেখি, ওগুলো গোরুরগাড়ি। তাদের প্রত্যেকের নিচে একটা করে হ্যারিকেনের আলো দুলছে। একটা বাগান থেকে লাঠি হাতে একটা লোক হঠাৎ বেরিয়ে এল, " কি ঠাকুরমশাই, আজ কোথায় ছিল?" বাবা আমাকে নিয়ে দাঁড়াল। উত্তর দিল। আমার পরিচয় দিল। আবার আমরা হাঁটতে শুরু করি। আমি লোকটার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে বাবা উত্তর দিল, ও এই এলাকার একজন বড়ো ডাকাত। উত্তর শুনে বাবার আরও কাছে ঘেঁষে যাই। তবে মনে একটা খটকা লেগেছিল, ডাকাত এত মোলায়েম করে কথা বলে? পরে বুঝেছি বাবা মানুষটা এতটাই বন্ধু ছিল সকলের যে ওর কোনো শত্রু ছিল না। আজ যে অন্ধকারকে ভয় পাই না, স্বজন বলে মনে হয় ------- তার মূলেও এই পথ। রাতের পর রাত পথ আমাকে একটু একটু করে অন্ধকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
হরিৎ:23/05/2017