পথ ---- ৫ -------------- হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় পথের ধুলোতে আমার পা ডুবে যাচ্ছে। হাওয়াই চপ্পল সমেত ধুলো থেকে আবার পা তুলছি। কোনো কোনো সময় ধুলোর চাপে জুতো থেকে ফিতে খুলে আসছে। আমি পথের ওপর বসে পড়ে জুতোর ফিতে পড়াচ্ছি। কখনও কখনও বাবাও পড়িয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার একবারের জন্যও বাবা বিরক্ত হচ্ছে না। প্রায় ছ'ফুট লম্বা ছিল বাবা। বেশ জোরে হাঁটত। হাঁটায় তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বেশ মুশকিল। কিন্তু পথের ওপর বাবাকে দেখতাম অন্য ভূমিকায়। যেন ও আমার হাত ধরে বেড়াতে বেরিয়েছে। কোনো ব্যস্ততা নেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। বাড়িতে এমনিতেই বাবা খুব কম কথা বলত। পথে সেটুকুও নয়। পথে নামার আগে অনুষ্ঠানবাড়িতে আমার সঙ্গে কথা হতো ------ "লুচি খেয়ে পেট ভরাবি না। মিষ্টি খাবি।" তরকারিতে ঝাল হলে জল খেতে দেখলে বলত, "জল খেয়েই পেট ভরালে খাবি কি?" এই মানুষটাই পথে নেমে একেবারেই অন্য মানুষ। বাবাকে চিনতে পারি না। পথই যেন তার আসল ঠাঁই। পথের বুকে নিজেকে মেলে ধরতেই তার সবচেয়ে বেশি স্বস্তিবোধ। আমি যেন বন্ধুর হাত ধরে আছি। চিরকালের বন্ধন। পথের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। বাবার এই বন্ধুবেশ সে ছাড়া আমাকে কেউ দেখায় নি। অভাবের করাল ছায়া আমাদেরকে সবসময় ঢেকে রাখতো। তার মাঝে বাবাকে দেখতাম কী ভীষণ নিরাসক্ত। কোনো কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করতে পারত না। পাশাপাশি আমিই একমাত্র বুঝতে পারতাম, সংসারের মাঝে তার চূড়ান্ত অসহায়তা। মানুষটা সংসারের চারদেয়ালের নয়। তাকে যেন কেউ জোর করে এখানে এনে ফেলে দিয়েছে। আমি দেখেছি পথে নেমে বাবা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এটাই যেন তার নিজস্ব পৃথিবী। শিশুর কাছে যেমন মায়ের কোল, বাবার কাছে তেমনি পথ। শান্তির আবাসস্থল। ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁর একটানা চিৎকারের মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটছি। গভীর অন্ধকার। হ্যারিকেনের কাচে কালি পড়ে গেছে, তাই তাতে আলোর চেয়ে অন্ধকারটাই বেশি। বাবা গান ধরল ----- "আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে"। জানতাম না বাবা গান গাইতে পারে। কোনোদিন তার মুখে গান শুনি নি। আমার পা আর চলছে না। আমি দাঁড়িয়ে গেছি। বাবাও একটা সেতুর ওপর এসে দাঁড়াল। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে ----- "আমার সামনে দিলি আঁধার মেলে, / মুখ লুকালি ----- মরি আমি সেই খেদে।" বাবার গলা কেঁপে গেল। মানুষের অন্তরের আক্ষেপ, দুঃখ যে কথা বলে ওঠে খোলা আকাশের নীচে নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মাঝে পথ আমাকে তা দেখিয়েছিল। আমার প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের কথা সুরকে মাধ্যম করে ওই অন্ধকারে বাবাকে কিছুটা পড়তে পারলাম। "অন্ধকারে অস্তরবির লিপি লেখা, / তোর প্রাণের বাঁশির তান সে নানা / সেই আমারই ছিল জানা, / আজ মরণ- বীণার অজানা সুর নেব সেধে" ------ কণ্ঠে কী ভীষণ আকুতি। আমি যেন বাবাকে ছুঁতে পারছি না। কোনো এক অচেনা পৃথিবীতে যেন সে চলে গেছে। জানি না কখন গান থেমে গেছে। সম্বিত ফিরল বাবার কান্নায়। সেতুর নীচে দিয়ে বয়ে চলা নদী, ওপরে আকাশের বুকে অগণন নক্ষত্র ----- বাবা শিশুর মতো কাঁদছে। মফস্বলের অন্ধকারে চোখ বুজলে একলা পাগলের কান্না আজও আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
হরিৎ: 24/05/2017