Home ব্লগবাজি অরূপ তোমার বাণী : পর্ব ২ ~ সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

অরূপ তোমার বাণী : পর্ব ২ ~ সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

0
অরূপ তোমার বাণী : পর্ব ২  ~ সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

অরূপ তোমার বাণী : পর্ব ২

সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

আমরা যখন ভাইজাগে যাই , তখন আমাদের টাউনশিপে , সেক্টার ফোর এ সপ্তাহে চারদিন হাট বসত । সেক্টর থ্রি বা ওয়ানেও এক একটি দোকানে কিছু সবজিপাতি আর মুরগী পাওয়া যেত । কিন্তু মাছটাছ পাওয়া যেত না । আমরা থাকতাম সেক্টর এইট এ । সেখান থেকে বাজার কমপক্ষে পাঁচ কিলোমিটার হবে । বাবা তাও অতটা রাস্তা ঠেঁঙিয়ে পরদিনই দুই থলে ভর্তি বাজার করে আনলেন।
কারন , আসার সময় চন্দননগর থেকে দুটি চাল ডাল , আলু বেঁধে এনেছিলাম । সে আর কতটুকু? পৌঁছনোর দিন সকালে সাত্যকি কোনোমতে ডিম আর সে দিনের কাজ চালানোর মতো কিছু মশলাপাতি কিনে দিয়েই অফিস ছুটেছিল ।

এই অপরিচিত জায়গায় , অপরিচিত ভাষায় , বাবা কিকরে ম্যানেজ করলেন , জিজ্ঞেস করে লাভ নেই । বাবা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যাতা হায় , খাতা হায় , করতা হায় সম্বল করে জীবনের চল্লিশটা বছর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে বছরে অন্ততঃ একবার বেড়িয়ে এসেছেন । এককালে মাইসোরে ওয়ার্ল্ড ডিজনির শিষ্য নরম্যান ম্যাক্লারেন্স এর কাছে ছ মাস অ্যানিমেশন পিকচার শেখার জন্য ছিলেন । ছ মাসে একটুও কন্নড় ভাষা শেখেন নি । উল্টে সেখানকার মানুষজন কে যদি বাংলা ভাষা শিখিয়ে এসে থাকেন তাতে বিন্দুমাত্র আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই । কারন , পরবর্তীকালে সেক্টর টেন এর “সুলতানা স্টোর্স ” এর মালিককে আমি বাবার সাথে ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলতে শুনেছি । এবং বাবা যখন শারীরিক অসুস্থতার কারনে ভাইজাগ যাওয়া বন্ধ করলেন , তখন তিনি বাবুজীর মতোন একজন বন্ধুর সাথে প্রাণের কথা মনের কথা না বলতে পারায় খুব দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন । সে যাক । বাবার গপ্প বলতে গেলে একখানা আস্ত বই লিখতে হয় ।

এবার মুদির জিনিষ কেনার পালা । দাদার এক বন্ধু সরকারদা বললেন , সেক্টর এইটের একটু বাইরে “হাজা” র দোকান আছে । সে দোকান ছোটো হলেও তাতে মুদির সব জিনিষপত্র পাওয়া যায় । এমন কি আইসক্রিম তৈরীর জন্য ,
সি এম এস , জি এম এস অব্দি থাকে । তা থাকুক গিয়ে ।আমার তখন আইসক্রিম না বানালেও চলবে । কিন্তু ওখানে আলু , পেঁয়াজ , রসুন , আদা , কাঁচালঙ্কা , ডিম , পাতিলেবু ও রাখে শুনে বড় নিশ্চিন্ত হলাম । দরকার পড়লে , চক্রবর্তী ভাতৃ যুগল কে আর কিছু না হোক ভাতের সঙ্গে ডাল , ডিমের ঝোল এবং আলুর বিভিন্ন পদ রান্না করে খাওয়ানোর জন্য, রসদ জোগাড় করতে, আমায় কয়েক কিলোমিটার পথ উজিয়ে যেতে হবে না ।

বাবা দ্বিতীয় দিন জলখাবার খেয়ে থলে হাতে বেরোতে যাচ্ছেন , তাঁর আদরের নাতনী ঝাঁপিয়ে পড়ল কোলে , সেও যাবে । আমি যত বোঝাই , সে আমার দিক থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নেয় । একখানা জবরদস্ত ধমক দিতে যাচ্ছিলাম, তার দাদু তাড়াতাড়ি তাকে প্র্যামে বসিয়ে রওনা দিয়ে দিলেন । ঘন্টা খানেক বাদে দেখি , রাজনন্দিনী তার দাদুর কোলে চেপে হাস্যমুখে আসছেন , আর তার মাতামহ ব্যাজার মুখে বাঁ কোলে নাতনী আর ডান হাতে প্র্যাম ঠেলতে ঠেলতে আসছেন । প্র্যামের মধ্যে মুদির বাজার । মনে মনে বললাম , বেশ হয়েছে , বেশী আদিখ্যেতার ঠেলা বোঝো। অবশ্য দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে বকতে বকতে মালপত্র বয়ে আনলাম ।

বাবা আটদিন থেকে, চন্দননগর ফিরে যাওয়ার পর এবার ঠেলা বোঝার পালা আমার । সাত্যকি বাজার করতে একদম ভালোবাসে না । আর আমাকে হাটে নিয়ে গেলে ওর খুব ঝামেলা । আমি ওর মতো একজনের কাছ থেকেই সব সবজি মোটেই কিনি না । এদিক সেদিক দু একবার পাক খেয়ে , যার কাছে যেটি সরেস সেটিই নিই । ফলে সাত্যকির খুচরো টাকায় টান পড়ে । হাট বেশ বড় এবং মোটামুটি সবাই হিন্দী বোঝে । সুতরাং আমায় পায় কে । আমি সারা হাট পরিভ্রমণ করে আগামী সাত দিনের বাজার বিভিন্ন জনের কাছে কিনি আর থলে ভর্তি করি । সাত্যকি মেয়ে কোলে গজগজ করতে করতে আমায় অনুসরণ করে । আমি আমার প্রয়োজন মতো কালা হতে পারি এবং থলে বেশী ভারী হলে বিনা চক্ষুলজ্জায় তা বরের হস্তগত করে তার বদলে আমার হাল্কা ফুল্কা মেয়েকে কোলে নিতে পারি । কে না জানে সদ্য একবছর আগে সিজারিয়ান হওয়ায় ,আমার বেশী ওজন টানা বারণ। তাই সাত্যকির এ ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া গতি কি ?

সাত্যকির বিপদের আরো কারন ছিল । এ হাট একেবারে বক্সিগঞ্জের পদ্মা পারের হাট । কি পাওয়া যায় না সেখানে ? শাক সবজি , ফলমূল , দশ কর্মা , বাসন কোসন , জামাকাপড় , চটি জুতো , ক্লিপ চুড়ি ইত্যাদি ,ইত্যাদি –। আমার বরের পকেট ফাঁকা করার পক্ষে একটি মস্ত গহ্বর । একে মাত্র বছর আড়াইয়ের বিয়ে করা বৌ , তায় মাঝে এতোদিনের দূরে থাকা , তার উপর বৌএর আবার পাহাড় প্রমান অভিমান , কিছু কেনাতে না বললে , বাজারের মধ্যেই চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ে , বেখেয়ালে, বিপরীত রাস্তায় চলন্ত বাসের পাশ দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে যায় । তারপর বাড়ী ফিরে মান না ভাঙালে পরদিন দেখিয়ে দেখিয়ে উপোস দেয় । বিস্তর হ্যাপা । আর নতুন পাতা সংসারে কি কেনার জিনিষের অভাব থাকে? সাত্যকি তাই পারতপক্ষে হাটে যেতে চাইত না ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here