অরূপ তোমার বাণী : পর্ব ৪ ~ সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

অরূপ তোমার বাণী : পর্ব ৪

সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

দাদার ফ্ল্যাটে প্রথমদিকে আমার কোনো কাজের লোক ছিল না । ভেবেছিলাম , বিদেশে তো সবাই বাড়ীর কাজ নিজেরাই করে নেয় , এতে তো কোনো হীনতা নেই । তাছাড়া চাকরি বাকরি করে যখন বরকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে পারছি না , বরং ওর ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছি , তখন বাড়ীর কাজ করে যেটুকু পুষিয়ে দেওয়া যায় । কিন্তু এই পারফেক্ট হোম মেকার হওয়ার বাসনা আমার অচিরেই ঘুচে গেল ।

রান্না করতে এবং খাওয়াতে আমি বরাবরই ভালোবাসি । এব্যাপারে তারুণ্যের পুষ্পতোরণ থেকে এই মধ্যবয়সের ঝরাপাতার সময় অবধি আমার উৎসাহে এতোটুকু ভাটা পড়ে নি । কিন্তু সেই সময় আমার রন্ধনের সাধন বা চুলা বলতে ছিল , তিনটি পাথরের উপর রাখা একখানি নগ্ন কয়েল , আর একটি কেরোসিন স্টোভ । তাতেই ভোর পাঁচটা থেকে দাদার সিফট হিসেবে রান্না , মেয়ের বোতল ফোটানো , জল ফোটানো , সাত্যকির ভাত ,ডাল , ভাজা , তরকারি, মাছের ঝোল এর লাঞ্চপ্যাক , গোবিন্দভোগ চাল, আলুসিদ্ধ, ডিমসিদ্ধ এর জলখাবার , এ সবই সারতে হত সকাল আটটার মধ্যে । আমি জানি আমার মা দিদিমাদের শুধু কেন আমার অনেক পাঠক বন্ধুদের হয়তো একসময় এর থেকে অনেক অনেক বেশী খাটুনি গেছে , কিম্বা এখনো প্রত্যহ হয়তো অমানুষিক পরিশ্রম করে তাদের গার্হস্থ্য এবং কর্ম জীবনে তালমেল বজায় রাখতে হয় ।

আমি আমার মাকে নিজেকে মেশিন বানিয়ে সংসারের কর্মশালায় বহুল ব্যবহারিত হতে হতে ধীরে ধীরে দেহ মনে বিকল হতে দেখেছি । মায়ের স্ট্রাগলের কথা মনে রেখেই তখন প্রতিদিন ঘড়ির অ্যালার্মের ডাকে নিজেকে একপ্রকার চাবকেই ভোরের শেষ ঘুমের আদর ছেড়ে উঠে পড়তাম । তখনো যে আমি নূতন যৌবনের দূত । ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় তখনো আমার ছায়া মারানোরও সাহস পেতো না ।

পৌনে নটায় সাত্যকি অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে আমি বাবলি কে নিয়ে পড়তাম । তার আবার মায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে ঘুম না ভাঙ্গলে জলখাবার খাওয়ার মেজাজ আসে না । মেয়েকে সংকৃতি মনষ্ক করে তোলার প্রচেষ্টায় বাঁশ টি যে আমাকেই খেতে হবে তা কি আর জানতুম ? বাবলির প্রাতরাশ পর্ব চুকিয়ে আমার সকালের প্রথম খাবার মুখে তুলতে বেশীরভাগ দিনই এগারোটা বেজে যেত ।

তারপর শুরু হত কাপড় কাচা , বাসন মাজা , ঘর ঝাঁট দেওয়া মোছা , বাবলিকে চান করানোর ফাঁকে ফাঁকে মেয়েকে কথা বলানোর প্রচেষ্টায় নাগাড়ে ছড়া বা কবিতা পাঠ । যথারীতি রাজনন্দিনীর দ্বিপ্রাহরিক ভোজনপর্বটিও বেশ দীর্ঘই ছিল । তখন আবার কবিতা নয় , বুদ্ধু ভুতুম গান গেয়ে বা ক্ষীরের পুতুলের কাহিনী শোনাতে হবে । তবে মেয়ের মুখ নড়বে ।

বিকেল হলে , কন্যার বৈকালিক আহার সমাধা করে সাজিয়ে গুছিয়ে বেড়াতে যেতে হত , আগেই বলেছি । ফিরে এসে তার বাপ জ্যাঠার জন্য চা জলখাবার বানানোর ব্যাপার থাকত । সাত্যকি ফিরলে আমার বেইমান মেয়ে আর আমায় চিনতেই পারতো না । আমার অবশ্য তাতে ভারী সুবিধাই হত , কিন্তু সত্যি বলছি , রাগও হত খুব ।

এখানে একটা কথা না বললে সত্যের অপলাপ করা হয় । আমার এতোক্ষণের লেখায় সন্তানকে বড় করার পদ্ধতি পড়ে আমাকে যাঁরা মনে মনে বাহবা দিচ্ছেন , তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই , এর মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর পর আমার কনিষ্ঠ কন্যা মিতুল কিন্তু মোটেই আমার এই একইরকম মনোযোগ পায় নি । সেও দেরীতে হেঁটেছে , দেরীতে কথা কয়েছে । তাতে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তিত হইনি, বা মুখে মুখে কবিতা বা গানে তাকে কথা বলতে অনুপ্রাণিত করিনি । আসলে তখন আমার সময় হতো না। দুই সন্তান আর তাদের পিতার মধ্যে সময় ভাগ করতে গিয়ে, কখনো কারুর ভাগে কিছু কম, কখনো কারুর ভাগে কিছু বেশী পড়ে যেত। সে অবশ্য আরো পরের ঘটনা।

যা বলছিলাম , যখন বোধোদয় হল যে , কাজের লোক ছাড়া আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না , তখন ঐ অজানা ভাষা সাগরের আমার একমাত্র ভেলা , দাদাদের মেসের রাঁধুনে সন্ন্যাসী রাওকে এত্তেলা দিলাম । এই কিশোরটির সাথে আমার পরিচয় প্রথমবার ভাইজাগ সফরে এসে । দাদার বিয়েতেও গিয়েছিল সন্ন্যাসী চন্দননগরে । ছেলেটি খুব ভালো হিন্দী জানে , বাংলা ও বোঝে অল্পস্বল্প । সন্ন্যাসী আমার হাতের বানানো পুডিং খেয়ে খুব তারিফ করলে , আর এই বলে আশ্বস্ত করলে , কাল ই ও কোনো এক বিশ্বস্ত কাজের লোক পাঠাবে । “এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে ” । গোদা বাংলায় , এইবার আমার ছড়ানোর খেল শুরু হল ।

পরদিন রবিবার । দাদার মর্নিং বা “এ” শিফট । এই সব দিনগুলিতে ভোর পাঁচটায় উঠে দাদার জন্য দুটো বাটার টোস্ট , ডিমের পোচ আর ব্ল্যাককফি বানিয়ে , আমি নিজেও এককাপ কড়া কালো কফি নিয়ে বাইরের অন্ধকারে বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম । আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলিতে এক একটি ঘরে আলো জ্বলে উঠত , মর্নিং ডিউটিতে যাওয়ার ব্যস্ততা শুরু হত । খুব অলস পায়ে আঁধারের বুক চিড়ে নতুন একটি দিনকে উঁকি দিতে দেখতে আমার বড় ভালো লাগত । চারপাশের পরিবেশ আর অচেনা ঠেকতো না । আমার চিরপরিচিত শহর আর এই শিল্পনগরীর বুকে একই রকম ভাবে ঊষার প্রকাশ আমায় ভুলিয়ে দিত বাবা মাকে ছেড়ে থাকার শূণ্যতা , প্রিয় শহর কে পিছনে ফেলে আসার মনোবেদনা ।

********************************************************

Share
Published by

Recent Posts

Swami Pradiptananda: হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হলে চুপ করে থাকব না, ঈশ্বর ওনাকে চৈতন্য দিন: কার্তিক মহারাজ

লোকসভা ভোটের প্রচারে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্ন্যাসী কার্তিক মহারাজকে উদ্দেশ করে অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগ…

1 hour ago

মা উড়ালপুলে যানজট নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্ঘটনা ঠেকাতে নয়া উদ্যোগ, প্রস্তাব যাবে নবান্নে

মা উড়ালপুল দিয়ে বিপুল পরিমাণ গাড়ি যাতায়াত করে থাকে। এটা শহরের ব্যস্ততম উড়ালপুল। এই উড়ালপুল…

4 hours ago

নষ্ট হওয়া ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বর্জ্য থেকে শহরবাসীকে মুক্তি, উদ্যোগ নিল কলকাতা পুরসভা

প্রযুক্তি ব্যবহারের জেরে শহরে বেড়েছে ইলেকট্রনিক আবর্জনা। এটাকেই অনেকে ই–বর্জ্য বলে থাকেন। শহরের প্রায় প্রত্যেকটি…

6 hours ago

Digha train: মোটরভ্যানের সঙ্গে দিঘাগামী লোকালের সংঘর্ষ, অল্পের জন্য রক্ষা যাত্রীদের

রবিবার সকাল ৮টা ৫৩ মিনিটে পাঁশকুড়া ছাড়ে দিঘা লোকাল। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ হেঁড়িয়া ও…

6 hours ago

নাগাড়ে বৃষ্টিতে তিস্তার জল বেড়ে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক, রংপো থেকে উদ্ধার তিন পর্যটক

উত্তরবঙ্গে এখন ভারী বৃষ্টির সতর্কতা জারি হয়েছে। কারণ পার্বত্য এলাকা–সহ পাঁচ জেলায় ভারী বৃষ্টি দেখা…

6 hours ago

Sundarbans: মাথায় ‘কুডুলের কোপ’, সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের হাতে খুন বনকর্মী

চোরা শিকারিদের হাতে খুন হলেন এক বনকর্মী।  রাতে টহল দেওয়ার সময় হামলা চালায় এক দল…

7 hours ago