” প্রণমামি মহাবীর পবন নন্দন
তোমার আশীষে রচি তোমারই ভজন,
করো কীর্তন নিজো গান নিজো গুণে,
কেশরীর ক্ষেত্রজাত জানে ত্রিভুবনে। “
হনুমান চাল্লিশের বন্দনা দিয়েই আজ না হয় শুরু হোক মঙ্গলবারর আর্তি। সিঁদুর, কাঁচা সরষের তেল আর প্রসাদে লাড্ডু সহ হনুমানজীর পূজো। তবে লাল ফুল, আবার হলুদ ফুল দিয়েও নিবেদন করা হয়। বিশেষ করে যারা মাঙ্গলিক এবং শনি ঠাকুরের দশায় আছেন তাঁদের ক্ষেত্রে এই পূজা করা হয়। কারণ শনির কোপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে হনুমানজীর কথা বলা হয়। যদিও শনির দশ দশা মানুষকে ভুগতেই হয়, তবু বলা হয় হনুমান যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞানী তাই তাঁর কাছে শনি তুষ্ট হন। তবে আজ দেরী কিসের, আসুন মঙ্গলবার তাই আজ জেনে নেওয়া যেতেই পারে ভারতের বুকে বিবিধ জায়গায় গড়ে ওঠা হনুমান মন্দিরের নাম।
সেই পুরাণের কাল ধরে চিত্রকূটের নাম আমাদের সকলের জানা। উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সীমানায় পথেই স্ফটিক শিলার হনুমান মন্দির। কথিত আছে, যে শিলায় বসেই প্রভু রাম ও তাঁর সহধর্মিণী সীতা অঙ্গরাগ করতেন। আর সেখানেই নাকি কাক ছদ্মবেশ ধারণ করতে একদিন রাজা দশরথের মন্ত্রী এবং ইন্দ্রের ঔরসে শচীর গর্ভজাত জয়ন্তী সম্ভোগের জন্য সীতার অনাবৃত জলসিক্ত স্তনে আঘাত করে। রামচন্দ্র নাকি তৃণ রূপ শর দিয়ে তাকে আঘাত করে, আর তার ডানচোখ অন্ধ হয়ে যায়। আর এই সত্য কথা সাক্ষাতের কারণে সীতা দেবী হনুমানকে বলেন। তাই এইস্থান খুব প্রচলিত বিশ্বাসের আধার। হনুমানজীর অবস্থানের স্থান হিসাবে নমস্য।
হনুমান ধারা…
মন্দাকিনী গঙ্গার ছোট পুল পেরিয়েই পিচের রাস্তা ধরে চিত্রকূট থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরেই হনুমান ধারা।পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঠে আসা পাহাড়ের গা বেয়ে খোদাই করা হনুমান মূর্তি। ঝকঝকে রুপোর চোখ, মাথায় রুপোর মুকুট নিয়ে দাঁড়িয়ে মূর্তি। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে জলধারা, হনুমান ধারা।
আবার একগল্পে হনুমান ধারার সরস্বতী গঙ্গা। তীব্র জলাভাব ও শুকনো ধরার আর্তি নিয়ে এলো হনুমানের মনে । আর ভক্তের অনুরোধে কি প্রভু থাকতে পারেন, তাই পাহাড়ের বুকে বাণ মেরে আনলেন সরস্বতী প্রবাহ। প্রভু রাম ও সীতার সাথে অবস্থান করছেন রঘুবীর। নিত্য ভক্তের সমাগম এই স্থানটিকে যথার্থতা দান করেছে।
উত্তরপ্রদেশের সঙ্কটমোচন মন্দির…
অসী নদীর তীর বেয়ে কেউ যদি কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যান তবে কাছেই মহাবীর মন্দির পাবেন। এখানে নাকি তুলসী দাস হনুমানজীর দেখা পান। ভাবা যায়, লৌকিক মতে তিনি নাকি নিত্য প্রভুর দেখা পেতেন। আর অনেকেই যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন, তাই ” রামচরিতমানস ” এর তুলসীদাস কে অনুসরণ করেও মানুষ আর্তি জানাতে পারেন, কারণ প্রভু কেবল ভক্তেরই কৃপা করেন।
মধ্যপ্রদেশের হনুমান মন্দির…
ভারতের মধ্যপ্রদেশে রাজধানী, ভোপাল থেকে ১৮০ কিমি দূরে নরসিংপুর জেলায় আছে পঞ্চমুখী হনুমান মন্দির। এই মন্দিরে অনেক ভক্তের সমাবেশ ঘটে। এখানে অনেক ভক্তের আনাগোনা থাকলেও বর্তমানে এটি উত্তেজনা প্রবন স্থান হিসাবে গন্য করা হয়েছে।
এবার আসি ঝান্দেবালা ও করোরবাগ মেট্রোর স্টেশনের মাঝে হনুমান মন্দির অবস্থিত। নাগা বাবা দ্বারা এই মন্দির ১৯৩১ সালে হলেও,১৯৯৪ সালে ১০৮ ফুটের এই মূর্তিবিশিষ্ট হনুমান মন্দির প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সারা দেওয়ালে রামচিরতমানসের বিবিধ কথা খোদাই এখানে আছে। উপর থেকে প্রাঙ্গনের সবটুকু দেখা যায়। সকাল ৬ টা থেকে ১০ পর্যন্ত খোলা মন্দিরে বহু মানুষের আসা যাওয়া চলে। তবে শনি মঙ্গল বার ছাড়া, হনুমান জয়ন্তীতে সপ্তাহ ধরে পুণার্থীদের ভিড় চলে আর তার সাথে মহাবীর সেবা বেশ ধূম করেই পালন করা হয়।
জয়পুরের হনুমান মন্দির…
জয়ুপুর কে ঘিরে আরাবল্লীর সুষম পরিবেশ ভারতের প্যারিস হিসাবে বিখ্যাত। এখানে শ্রীকাল হনুমান মন্দির অন্যতম। চাঁদী টক্সালের এই মন্দির ভক্তদের একবারে নিজস্ব জায়গা। কারণ বহু ভক্তের সমাগম এই মন্দিরকে ভরিয়ে তুলেছে দিন দিন, আর বুঝিয়ে দিচ্ছে মন্দিরের গুরুত্ব। এই মন্দিরে হনুমানজী কালো রূপ ধারণ করেছেন। শিল্পীর হাতে বাস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে উঠেছে এই মন্দির। এখানে বলা হয় শিক্ষা শেষ হবার পর হনুমানজী যখন সূর্যদেবের কাছে আসেন, তখন সূর্যদেব জানান যে,শনি, সূর্যদেব কে অবজ্ঞা করে তাই তাকে সূর্য দেবের কাছে এনে দিতে হবে। এদিকে তাঁকে আনতে গেলে শনিদেব খুব রেগে যায় আর হনুমানের উপর কু দৃষ্টি দেন। এতে হনুমানজী কালো হয়ে যান। শেষে শনি দেব, হনুমান জীর গুরুভক্তিতে প্রসন্ন হন আর কথা দেন যে, হনুমানজীর যারা ভক্ত তাঁরা শনির প্রভাব মুক্ত হবেন। সেই থেকে তিনি জয়পুরে কৃষ্ণ রঙ ধারণ করে বিরাজমান।
আহমেদাবাদের মির্জাপুরের হনুমান গলি…
এবার আসি আহমেদাবাদের মির্জাপুরের হনুমান গলিতে, পুরানো হনুমান মন্দির। যা এই কিছুদিন আগে সংস্কার করা হলো। পুরানো মন্দির হিসাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।এই মন্দিরটি ছিল ৫০০ বছরের পুরানো। গোধরা গুজরাতের এক মুসলিম এই সংস্কার করেন। নামে কি এসে যাই, ভক্তিটাই বড়ো, এ কথা তিনি আরো একবার প্রতিষ্ঠা করলেন।
ছত্রিশগড়ের রতনপুরের গীর্জাবন্ধের হনুমান মন্দির…
এখানে হনুমানজী নারী মহামায়া আদলে গঠিত। তাই তাঁকে নারী রূপে পূজা করা হয়। এখানে রাজা পৃথ্বভি দেবজু নামে এক সম্রাট বাস করতেন।তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আর তারপর মহাবীরের স্বপ্নাদেশেই হনুমানজী নারী রূপে পূজিত হন। তবে এখানে তিনি দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসে আছেন তাই দক্ষিণা মূর্তি ” হিসাবে পরিচিত হন।
বিকানীরের মহাবীর মন্দির…
এরপর আসি বিকানীর শ্রী মানসপূরণ, সদুলগঞ্জের মহাবীর মন্দির। যেখানে বহু মানুষের আসা যাওয়া নিত্য লেগে থাকে। অনেক মন্দির থাকলেও এই মন্দিরের হনুমান জীর চরণে মাথা ঠুকতে কেউ ভোলে না।
রাজস্থানের সালাসের বালাজী মন্দির...
সকল কিছুর মধ্যে রাজস্থানের সালাসের বালাজী না বললে অনেক বড়ো আক্ষেপ থেকে যায়। এখানে বাবা মোহন দাস এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আর এখানে আগে বাবা মোহন জীর চরণে মাথা ঠুকে তবেই মহাবীরের মন্দিরে যান। এখানে মহাবীর সেই ২৫৫ বছর ধরে অবস্থান করছে বলে ভক্তদের বিশ্বাস। বলা হয় যে,
” ভূত প্রেত দ্বৈত দানব যার নাম গানে,
কাছেতে আসে না কেহ জেনো সব মনে “
এই মন্তব্য সালাসের বালাজীর মন্দিরের ক্ষেত্রে যথার্থ।
গুজরাটের সারংপুরের হনুমানজী মন্দির…
গুজরাটের সারংপুরে আছে মহারাজ, অধিরাজ নামে খ্যাত সোনার সিংহাসনে উপবিষ্ট কষ্টভঞ্জন হনুমানজী।এখানে পদতলের শনিদেবের স্ত্রী আকারের মূর্তি স্বামী নারায়ন করেন,যা শনির প্রকোপ থেকে সব ভক্তদের রক্ষা করেন। ৪৫ কিলো সোনা ও ৫০ কিলো রুপো সিংহাসনের উপরে উপবিষ্ট হনুমানজী। এখানে এলে সকল দর্শনার্থীর মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এখানে হনুমান জীর পায়ের তলায় শনিদেব আর সোনা গদা অবস্থান করছে। এছাড়াও পাশাপাশি সৈনিকেরা অবস্থান করছেন। এই মন্দির কোন রাজমহলের থেকে কম নয়।
এছাড়াও বর্ধমানে পানাগড়ে আছে ” ঘন্টা বাবা, যেখানে হনুমানের বিশাল মূর্তি দর্শনার্থীদের কাছে উল্লেখযোগ্য। কর্ণাটকের যন্ত্রধারকা, অযোধ্যার বুকে হনুমানগড়ি, ফোর্ট সংলগ্ন এলহাবাদের মন্দির ইত্যাদি …
” অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে তার নাইকো তুলনা,
করপুটে করি আমি তাহার ভজনা “
আজ করপুটে পবনপুত্র পরম ব্রহ্ম জ্ঞানী স্বরূপ হনুমান জীকে প্রণাম জানাই। ব্রহ্মচারী যোগী মঙ্গলময় সঙ্কটমোচন মহাবীরে আধার মন্দিরে মন্দিরে আসমুদ্র হিমাচল ” ঘিরে অবস্থান করছে। আর সেই মন্দিরে মন্দিরে আজ হনুমান চালিশা পাঠে স্মরণ করি নিরন্তর।