ওয়েব ডেস্কঃ আজকের এই পৃথিবীতে যেখানে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে থাবা গেড়ে বসেছে সেখানে এখনো পর্যন্ত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা মাথা উঁচু করে নিজেদের শাসনতন্ত্র পুরুষদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কথাটির অর্থ হলো পরিবার, রাজ্য অথবা একটি গ্রুপ যেটি সম্পূর্ণভাবে মহিলা শাসিত অর্থাৎ পরিবারের কর্তৃত্ব একজন মহিলার হাতে থাকে, সেই পরিবারকেই মাতৃতান্ত্রিক পরিবার হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়।নারীবাদীরা যদিও আরো জটিল ভাবে এই মাতৃতন্ত্রের ব্যাখ্যা করেছেন তবুও এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সমস্ত সম্পত্তি বংশানুক্রমিকভাবে মহিলাদের মধ্যেই হস্তান্তরিত হয়। এক্ষেত্রে কোন একজন সন্তান তাঁর মায়ের থেকে যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে। আসুন জেনে নেওয়া যাক এমন কতকগুলি সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে যেখানে মাতৃতন্ত্রই প্রধান।
তিব্বতের সীমানায় বসবাসকারী ইউনান এবং সিচুয়ান প্রদেশের কাছে মোসুওরা সম্ভবত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম সেরা দৃষ্টান্ত।চীনের সরকার সরকারিভাবে এই জাতিটিকে সংখ্যালঘু এবং “Naxi “নামে ঘোষণা করলেও এই নাক্সিদের থেকে মোসুওরা সংস্কৃতি এবং ভাষাগত দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি পরিবার এখানে নিজস্ব বাড়ীতে বসবাস করে নিজস্ব সম্পত্তি নিয়ে এবং প্রত্যেকটি পরিবারের প্রধান এখানে একজন মহিলা। বংশানুক্রমিকভাবে এই মহিলারাই পরিবারের প্রধান হয়ে যান এবং সকল সম্পত্তি ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা হিসাবে সেই মহিলাদের বংশধরদের উপর হস্তান্তরিত হয়। মোসুয়া মহিলারা ব্যবসা এবং রাজনীতির সমস্ত ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।সকল বাচ্চারা তাদের মায়ের কাছে বড় হয় এবং মায়ের নাম গ্রহণ করে। মোসুয়াদের বিবাহ পদ্ধতিটি “walking marriages” নামে পরিচিত।এখানে কোনো রকম বৈবাহিক প্রতিষ্ঠান নেই । মহিলারা তাদের পছন্দ মত যে কোন জায়গা থেকে অথবা যেকোনো ঘরের পুরুষকে গ্রহণ করতে পারেন এবং দম্পতিরা একত্রে বসবাস করেন না। যেহেতু সকল বাচ্চারা মায়ের যত্নে বেড়ে ওঠে সেহেতু বাবাদের কোন ভূমিকা থাকে না বাচ্চাদের বড় করার ক্ষেত্রে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিতৃ পরিচয় জানা যায় না। সমস্ত পুরুষেরও শৈশব তার মহিলা তান্ত্রিক পরিবারের গৃহকত্রীর সাহচর্যে কাটে।
ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সুমাত্রার প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষের জনবসতিপূর্ণ মিনাঙকাবাউ আজকের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উদাহরণ বলা যেতে পারে। স্থানীয় আদিবাসী আইন অনুসারে সকল সম্পত্তি মায়ের তরফ থেকে মেয়ের কাছে যায় এবং এই মিনাঙকাবাউ সমাজ ব্যবস্থায় মনে করা হয়, মা হলেন সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই সমাজ ব্যবস্থায় মহিলারা প্রধানত ঘরের সকল ব্যাপারে আধিপত্য বিস্তার করেন আর পুরুষরা রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক দিকে আধিপত্য বিস্তার করেন। মহিলা এবং পুরুষ উভয়েই ক্ষমতার বিচ্ছেদকরণ বা separation of powers য়ে বিশ্বাস করে এবং প্রত্যেকেই সমান ক্ষমতা ভোগ করে। বিবাহের সময় প্রত্যেক মহিলা তার নিজের ঘুমোবার জায়গাটি স্থির করেন।প্রত্যেক পুরুষ স্বামী হিসাবে তার স্ত্রীর সাথে রাত্রি বাস করে কিন্তু সকালবেলায় প্রাতঃরাশের জন্য তার মায়ের বাড়িতে ফিরে যায়। দশ বছর বয়সে প্রত্যেকটি ছেলে তার মায়ের গৃহত্যাগ করে পুরুষদের জন্য নির্ধারিত কোয়ার্টারে গিয়ে বসবাস করে এবং সেখানে হাতে কলমে বিভিন্ন কাজকর্ম এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান শিক্ষা করে। এক্ষেত্রে উপজাতির প্রধান একজন পুরুষ হলেও একজন মহিলাই কিন্তু এই প্রধান কে নির্বাচন করে এবং প্রয়োজনে তাকে সেই পদ থেকে সরিয়েও দিতে পারে যদি সে তার নিজের দায়িত্ব পালনে সক্ষম না হয়।
ঘানাতে এই আকান জনজাতির লোকজন সংখ্যাধিক্য নিয়ে বসবাস করে। আকামের সামাজিক সংগঠনগুলি মূলত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যেখানে কোন একজনের ব্যক্তিগত পরিচয়, সম্পত্তি রাজনীতি এবং বংশানুক্রম সবকিছু নির্ধারিত হয় মাতৃতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে। সকল মাতৃতান্ত্রিক প্রধানরাই এখানে সমাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন আর পুরুষরা ঐতিহ্যগতভাবে সমাজের কিছু লিডারশীপ ভূমিকা গ্রহণ করে।এখানে বংশানুক্রমিক কথাটির অর্থ হলো সবটাই মাতৃতান্ত্রিক অর্থাৎ একজন পুরুষের মা এবং বোনেরা এবং তাদের সন্তানরাও সমাজ এবং পরিবারে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। অনেক সময় একজন পুরুষ তার নিজের পরিবারকে কোন ব্যাপারে সমর্থন না করলেও একজন মহিলা আত্মীয় তার নিজের পরিবারকে অতি অবশ্যই সমর্থন করেন।
এটি হল একটি ক্ষুদ্র স্থানীয় এবং দেশীয় জনজাতি যারা মাত্র ১৩,০০০ জনসংখ্যাতেই সীমাবদ্ধ। এরা বসবাস করে কোস্টারিকার লাইমন প্রদেশের তালামাঙ্কা ক্যান্টনে। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত এরাও গোষ্ঠীবদ্ধ অবস্থায় বসবাস করে এবং প্রত্যেকটি গোষ্ঠী বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত। প্রতিটি পরিবার এবং গোষ্ঠীর প্রধান একজন মা অথবা মহিলা হন।মহিলারা এখানে একমাত্র যারা ঐতিহ্যগতভাবে এবং বংশানুক্রমিকভাবে সম্পত্তি ও জমির মালিকানা ভোগ করেন। এখানকার ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে কোকো প্রস্তুত ও ব্যবহার করা হয় তার প্রস্তুতিও মহিলারাই করে থাকেন।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসি প্রতিবেশীদের মতন তিব্বতী – বার্মা ভাষায় কথা বলা গারো জনজাতির লোকজন সকল সম্পত্তি এবং রাজনীতির সমস্ত ব্যাপারে বংশানুক্রমিকভাবে “মায়ের থেকে মেয়ে” — সেই ভাবেই সকল কিছুর ব্যবস্থা হয়। অনেকটা আকান জনজাতির মতন সকল সমাজব্যবস্থাই মাতৃত্বপ্রধান, যদিও সমাজে সকল সম্পত্তির সংরক্ষন পুরুষরাই করে থাকে।কিন্তু সকল সম্পত্তি বংশানুক্রমিকভাবে মায়ের থেকে মেয়ের তরফে যায়। সাধারনত সকল সম্পত্তি মায়ের তরফ থেকে মেয়ের দিকে গেলেও যে সকল মেয়েরা মায়ের সম্পত্তি পায় না তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেক বেশি জটিল হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহের পরে একজন পুরুষ তার স্ত্রীর গৃহে বসবাস করে। এদের বিবাহ কখনোই সারা জীবনের একসাথে থাকার বাধ্যতামূলক নয়।
নিউ গিনির পশ্চিমে অবস্থিত দক্ষিণ বোগেনভিল নামের একটি দ্বীপে নাগোভিসিরা বসবাস করে।নৃতত্ত্ববিজ্ঞানী জিল ন্যাসের রিপোর্ট অনুযায়ী নাগোভিসি সমাজ ব্যবস্থা প্রধানত মাতৃতান্ত্রিক এবং দুই ভাগে বিভক্ত। জনগোষ্ঠী এখানে দুটি অংশে বিভক্ত থাকে। নাগোভিসি মহিলারা লিডারশীপ এবং উৎসবের সমস্ত ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ভাবে জড়িত থাকে। সব থেকে বেশি সম্মান প্রদর্শিত হয় যখন সম্পত্তি বা জমিরর মালিকানা বংশানুক্রমিকভাবে হস্তান্তরিত হয় মহিলা ভিত্তিকভাবে।নাগোভিসি মহিলারা বাগান বা কৃষির মতই যৌনতাকেও সমান প্রাধান্য দেয়। বিবাহ এখানে সংগঠিত নয়। যদি কোন দম্পতি একসাথে এক জায়গায় খাওয়াদাওয়া করে, ঘুমোয়, ঘোরাফেরা করে বা কোন পুরুষকে যদি কোন মহিলার সাথে বাগান তৈরী বা কৃষিকাজে সাহায্য করতে দেখা যায়, তাহলে মনে করা হয়, তারা বিবাহিত।
তবুও আজকের নারী দিবসে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই মহিলারা অবহেলিত এবং তাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে আজ অবধি কমেনি। বরং দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন তাদের সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পরিপন্থী। আমরা আজও আশা করি নারী তার শ্রেষ্ঠ আসন এই সমাজে পাবে যেখানে পুরুষ নারীকে শুধু মাত্র তার যোগ্য সম্মানই শুধু দেবে না বরং মহিলা তান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকল পরিবার অন্তর্ভুক্ত হবে।