অন্বেষণ :— বৈশাখী চ্যাটার্জী

অন্বেষণ :---

অনুভূতি গুলো তখন একেবারেই রঙিন -অথচ কাঁচা ,-?মনের মধ্যে প্রথম প্রেমের ছোঁয়া
--ধাপে ধাপে সেই প্রেম আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছিল-তুমি সেদিন ও ছিলে অন্বেষণ
l-তুমি আমার প্রেম না --আমার প্রেমের সমস্ত মূহুর্ত গুলো আমি তোমার সাথে ভাগ
করে নিতাম ,আমার ভাল খারাপ সবটুকুতেই তুমি ছিলে সেই প্রথম দিন থেকে...কি সবুজ
ছিলে তুমি তখন ,
সবুজ হাসিতে ভোরে থাকত তোমার মুখ ,আমার সবটুকু জুড়েই তোমার অন্বেষণ ছিল ।

              তখন আমি অনেক ছোট ,প্রথম প্রেমে পড়ি মৃদুলদার --মৃদুলদা বয়সে
আমার থেকে অনেক টাই বড় ছিল -কিন্তু খুব ভাল লাগত --ওই ছোট বয়সে যা হয় ভুল ঠিক
ভাল মন্দ -সবই কেমন গুলিয়ে যায় ,আমার ক্ষেত্রেও একই হয়েছিল --এটা কোর না
--ওখানে যাবে না -এই ড্রেস পড়ো না সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম ,..তখন
মৃদুলদাই সব ।শেষে একটা বড় চাকরি পেয়ে ---মোটা টাকা পন নিয়ে বিয়ে করল মৃদুলদা
,আমাকে তখন মৃদুলদার পাশে নাকি একেবারেই বেমানান......।

             চুটিয়ে প্রেম করার দিন গুলোতে কেমন যেন ভেসে ছিলাম --তাই
অন্বেষণকে সে ভাবে অনুভব করিনি ,কিন্তু আজ এই কষ্টের মুহুর্তে তার বুকে আমি
মাথা রেখে কেঁদেছি --চিরদিনের একখানা জায়গা দিয়েছিল সে আমাকে মাথা গুঁজে
কাঁদার -হাসার ,সে আমাকে বোঝাত --শক্ত হতে শেখাত ,কখন যে ওকে ভালবেসে ফেলি
বুঝতে পারিনি --শুধু নীরব অপেক্ষায় থাকতাম একবার ওর মুখ থেকে ভালবাসার কথা
শুনব বলে --কিন্তু কোনদিন অন্বেষণ আমাকে ভালবাসার কথা বলেনি --বড্ড চাপা
অভিমান কাজ করত আমার মধ্যে --মনে মনে ভাবতাম আমাকে কি ভালবাসা যায় না ?স্কুল-
কলেজের গন্ডি পেরোলাম --বাবা- মা বিয়ের ঠিক করল ,অন্বেষণকে সব জানালাম -ভাবলাম
যদি বলে কিছু কিন্তু ও কিছুই বলেনি --আমিও আর কথা বাড়াই নি ,তবে মনে মনে খুব
কষ্ট পেয়েছিলাম......।

              বিয়ে হয়ে গেলো ,খুব ভাল বর --খুব ভাল ঘর ,আমিও খুব সুখে সংসার
করতে লাগলাম ,অন্বেষণ কোথায় যেন হারিয়ে গেল --অবশ্য তাকে খোঁজার তেমন কোন
ইচ্ছেও আমার হয়নি ,মনের সবটুকু অনুভূতির কথা বরকেই বলতাম --ভালবাসা ,ঝগড়া
সবকিছুর মাঝেই এগিয়ে চলতে থাকি ,দেখতে দেখতে সময় এগোয় দুটো মেয়ের জন্ম হয় ,বড়
যত্ন করে মনের সমস্ত অপূর্ণ ইচ্ছে গুলো দিয়ে তাদের মানুষ করতে থাকি --আমার
স্বামী অনীশ ব্যাংকে চাকরি করত --খুবই চাপ থাকত কাজের -মেয়েদের সমস্ত দায়িত্বই
আমার কাঁধে এসে পরে --এখন মাঝে মাঝে ফোন করে অন্বেষণ খবর নেয় -কেমন আছি, কি
করছি -সারাদিনের সব ক্লান্তির মাঝে ওইটুকু যেন খোলা হাওয়া বয়ে যায় জীবনে ,

         বিবাহিত জীবনটা সবারই একটা গন্ডিতে বাঁধা থাকে --সেই গন্ডির ভিতরে
আমাদের অনেক দায়িত্ব -কর্তব্য থাকে ,তবুও সেই গন্ডির ভীতর থেকে মন মাঝে মাঝেই
 উঁকি ঝুঁকি দেয় খোলা আকাশের দিকে --যদিও অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহিত জীবন
পরিপূর্ণ থাকে -সেখানে কোন ফাঁকি থাকে না -অভাবও থাকে না ,নিবিড় এক বাঁধনে
আবিষ্ট থাকে দুটো মানুষ -অত সহজে সে বাঁধন ছেঁড়া যায় না --,কিন্তু এই গন্ডির
বাইরে -আমাদের দাম্পত্যের- বাইরে আমাদের মনের নিজস্ব একটা জগৎ থাকে --তা
প্রত্যেকের অনুভুতিতেই স্বাধীন হয় -সকলেই নিজের মতন করে সেই জগতে একটু বাঁচতে
চায় ,
যেমন সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা ঢেউ গুলোকে গুনি না শুধু দেখে যাই
,সেখানে ক্লান্তি আসে না -শুধু ভাললাগা কাজ করে ,--প্রথম বর্ষার বৃষ্টিতে
ভিজতে যেমন ভাল লাগে -অথচ বৃষ্টিকে ভালবেসে রোজ ভেজা যায় না....,
অনেকটা সেইরকম ভাবে অন্বেষণ আমার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত জায়গা নিয়ে রয়ে
যায়......।যাকে আমি অনুভব করতাম খুব কাছ থেকে ,আমার সব অপূর্ণ ইচ্ছে -অনিচ্ছার
একটা চাপা স্বপ্ন ছিল অন্বেষণ..।

                মেয়েরা বড় হতে থাকে -বয়সও নিজের মতন করে বেড়ে চলে ,হঠাৎ করেই
অনীশ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ,এ ডাক্তার ও ডাক্তার -শেষে ধরা পড়ে ওর কিডনি দুটো
বিকল হয়ে গেছে......,অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি অনীশ কে...।মেয়েরা তখন
স্কুলের গন্ডি পেরোয় নি -যেন অগাধ সমুদ্রে এসে পড়ি ,আমার চিরদিনের অসময়ে
অন্বেষণ আমার পাশে থেকেছে..সাহস দিয়েছে আমার সমস্ত লড়াই আমাকে লড়তে শিখিয়েছে
,বাস্তবকে অস্বীকার করা চলে না -জীবনের আরও অনেকটা পথ বাকি ,
অনেক দায়িত্ব বাকি...,নিজেকে শক্ত করি ,আরও দৃঢ় ভাবে নিজেকে দাঁড় করাই ,বড্ড
অসময় গুলোতে অন্বেষণ এর বুকে মাথা রেখে কেঁদেছি বার বার -বড় মনের জোর পেতাম
,একটা অদ্ভুত সম্পর্ক ,নামহীন ,গন্তব্য হীন, অথচ একটা বন্ধন মনের সাথে মনের
বন্ধন...!বড্ড ভরসার একটা জায়গা ,এরকম একটা মানুষকে পাশে পেলে যেন পৃথিবীর সব
লড়াই লড়া যায়......।

           আনিশের চাকরিটা আমি পেয়ে যাই..যদিও একটু সময় লেগেছিল ,তবে তারপর
স্বভাবিক জীবন ফিরে আসতে শুরু করে...,সময় কষ্টকে অনেক কমিয়ে দেয়..কমিয়ে দেয়
এইজন্য বলছি কারন সব কষ্ট ভোলা যায় না ,মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া এসে এনে দিয়েছে
কিছু ব্যাথা ,কত রাত জেগে কেটে গেছে...কত আবছা ছায়ায় অনুভব করেছি অনীশকে...,কত
ঘুমন্ত মূহুর্ত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে অনীশ,..যে মরে যায় সে তো শুধু
একা মরে না তার সঙ্গে তার ছায়াসঙ্গীরাও মরে,একটা মৃত্যু দেহের আর একটা মৃত্যু
মনের ,তবুও বেঁচে থাকতে হয়...তবে বেঁচে থাকা বড় দায় হয়ে পড়ে ।

          মেয়েদের পড়াশুনা শেষ হবার পর একে একে বিয়ে দিয়ে দিলাম ,সংসারে এখন
আমি একা ।..অন্বেষণ আসে মাঝে মাঝে ,বড় অভিমান হয় ওর ওপর বড় প্রশ্ন করতে ইচ্ছে
হয় কেন -কেন এতো গুলো বছর শুধু নীরবে....কিন্তু বলা হয় না কিছুই ,সেই সবুজ
অন্বেষণ আর সবুজ নেই -বার্ধক্য গ্রাস করেছে তাকেও ,চুলে পাক ধরেছে ।একসাথে
মুখোমুখি বসি কত গল্প করি পুরন দিনের...সময় কেটে যায়..।

       সময়ের হাত ধরে দেখতে দেখতে জীবনের সায়াহ্নে এসে উপস্থিত...!হসপিটালের
বেডে তখন প্রায় নিভন্ত আমি...,মেয়ে -জামাই ,নাতি -নাতনি তখন সবাই চোখের জল
ফেলছে..,অন্বেষণ অনেকটা দুরে দাঁড়িয়ে আছে...বড্ড ফ্যাকাশে লাগছে ওকে ভীষণ মলিন
,কখন কখন আবার সেই সবুজ রূপে দেখছি ,হাত নেড়ে কাছে ডাকলাম,ও কাছে এসে আমার হাত
দুটো চেপে ধরলো ,বলল বলো কি বলবে ?আমি অপলক ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমার সামনে
বসে সেই প্রথম দিনের অন্বেষণ -আমার সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তবে কে এই
অন্বেষণ ?একি আমার সমস্ত জীবনের অন্বেষণ ??একি আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সেই
অন্বেষণ ??

            আজ জীবন সায়াহ্নে এসে উপলব্ধি করলাম বা আমার অন্বেষণ আমাকে
উপলব্ধি করিয়ে দিল যে সে শুধুই আমার সারা জীবনের খোঁজ ছিল....,আমাদের প্রতিটি
মুহূর্তের পাওয়া না পাওয়ার হিসেবের মাঝে আমরা সব সময় মনের অপূর্ণ ইচ্ছে টাকে
খুঁজে চলি...!সেটা আমাদের অন্বেষণ ।ভালবাসার মানুষের কাছে থেকেও কোথাও একটা
অপূর্ণতা খোঁজে কাওকে সেই চাহিদা অন্বেষণ.....।যার অস্তিত্ব শুধুই আমাদের মনে
থাকে..।।

                          বৈশাখী চ্যাটার্জী
                            23/04/2017

Share
Published by

Recent Posts

Swami Pradiptananda: হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হলে চুপ করে থাকব না, ঈশ্বর ওনাকে চৈতন্য দিন: কার্তিক মহারাজ

লোকসভা ভোটের প্রচারে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্ন্যাসী কার্তিক মহারাজকে উদ্দেশ করে অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগ…

2 hours ago

মা উড়ালপুলে যানজট নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্ঘটনা ঠেকাতে নয়া উদ্যোগ, প্রস্তাব যাবে নবান্নে

মা উড়ালপুল দিয়ে বিপুল পরিমাণ গাড়ি যাতায়াত করে থাকে। এটা শহরের ব্যস্ততম উড়ালপুল। এই উড়ালপুল…

5 hours ago

নষ্ট হওয়া ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বর্জ্য থেকে শহরবাসীকে মুক্তি, উদ্যোগ নিল কলকাতা পুরসভা

প্রযুক্তি ব্যবহারের জেরে শহরে বেড়েছে ইলেকট্রনিক আবর্জনা। এটাকেই অনেকে ই–বর্জ্য বলে থাকেন। শহরের প্রায় প্রত্যেকটি…

7 hours ago

Digha train: মোটরভ্যানের সঙ্গে দিঘাগামী লোকালের সংঘর্ষ, অল্পের জন্য রক্ষা যাত্রীদের

রবিবার সকাল ৮টা ৫৩ মিনিটে পাঁশকুড়া ছাড়ে দিঘা লোকাল। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ হেঁড়িয়া ও…

7 hours ago

নাগাড়ে বৃষ্টিতে তিস্তার জল বেড়ে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক, রংপো থেকে উদ্ধার তিন পর্যটক

উত্তরবঙ্গে এখন ভারী বৃষ্টির সতর্কতা জারি হয়েছে। কারণ পার্বত্য এলাকা–সহ পাঁচ জেলায় ভারী বৃষ্টি দেখা…

7 hours ago

Sundarbans: মাথায় ‘কুডুলের কোপ’, সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের হাতে খুন বনকর্মী

চোরা শিকারিদের হাতে খুন হলেন এক বনকর্মী।  রাতে টহল দেওয়ার সময় হামলা চালায় এক দল…

8 hours ago