ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলির মধ্যে দোল বা বসন্ত উৎসব অন্যতম যা এসেছে ‘দোলনা’ থেকে৷ এই উৎসব ভারতের পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চলে উদযাপন করা হয়ে থাকে। আগে দোল এবং হোলি ছিল আলাদা যা বর্তমানে সম্পৃক্ত।
হোলি অপভ্রংশটি এসেছে হোরি (তৎসম) বা দোল থেকে। হোলি থেকে হোলক, হোলক মানে হোলিকা, যার অর্থ ডাইনী। এর সঙ্গে অশুভকে ধ্বংস ও নতুনকে বরণ করা হয়। ভারতের উড়িষ্যায় দোলোৎসব, উত্তর ও মধ্যভারতে হোলি বা হোরি, গোয়া ও কঙ্কণ অঞ্চলে শিমাগা, দক্ষিণ ভারতে কামায়ন নামে একে অভিহিত করা হয়। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়।
হিন্দু ধর্মানুসারে চারটি যুগ হল সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ ও কলিযুগ। দ্বাপরযুগ থেকে শ্রীকৃষ্ণের দোল উৎসব চলে আসছে। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। আবার, ১৪৮৬ সালের এই পূর্ণিমা তিথিতেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে একে গৌর-পূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।
এ সব দিক থেকে দোল উৎসবকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। হিন্দুধর্মের পৌরাণিক উপাখ্যান ও শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব। পৌরাণিক উপাখ্যানের দুটি দিক। স্কন্ধপুরাণের ‘হোলিকা’ এবং রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী। প্রথমটিতে স্কন্ধপুরাণ গ্রন্থের ফাল্গুন মাহাত্ম্য গ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান জড়িত।
দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা। হিরণ্যকশিপু অপরাজেয় থাকার বর পেয়েছিল। তাই কোনও দেবতাকেই মানত না। কিন্তু হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত হওয়ায় হিরণ্যকশিপু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। নানা ভাবে ছেলেকে বুঝিয়ে বা শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেও ফল না পেয়ে শেষে প্রহ্লাদকে হত্যা করতে জ্বলন্ত চিতায় বসল হোলিকা যার নিজের গায়ে অগ্নিনিরোধক বস্ত্র ছিল। কিন্তু আগুন জ্বলে উঠতেই সেই বস্ত্র উড়ে গিয়ে প্রহ্লাদকে ঢেকে ফেলল এবং অগ্নিদগ্ধ হোলিকার মৃত্যু হয়।বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারের আবির্ভাব হয় এবং তাঁর হাতে নিহত হয় হিরণ্যকশিপু। ওই আগুন হল অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের প্রতীক। হোলিকা দগ্ধ হওয়ার পরের দিন পালিত হয় হোলি।
রাধা কৃষ্ণের প্রেমের কাহিনী বর্ণনাই এই উৎসবের মাহাত্ম্য রচনা করেছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে বৃন্দাবনের নন্দন কাননে শ্রীকৃষ্ণ আবির সহযোগে রাধা ও তেত্রিশ হাজার গোপীর সঙ্গে রঙ খেলায় মেতে ছিলেন। রঙিন প্রেমের স্মারকের স্মরণে এ দিন সকালে ভগবানকৃষ্ণ ও রাধার বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নান করিয়ে দোলায় চড়িয়ে কীর্তন গানসহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর কৃষ্ণভক্তরা আবির নিয়ে একে অপরকে রাঙিয়ে দেন। এ আবির খেলার স্মরণে হিন্দু সম্প্রদায় এই হোলি উৎসব পালন করে থাকে বলে প্রচলিত আছে। এ ছাড়াও কথিত, কৃষ্ণ নিজের কৃষ্ণ রঙ ঢাকতে বিভিন্ন ধরনের রঙ মেখে রাধার সামনে আবির্ভূত হন। সেই থেকে এ উৎসবের শুরু।
কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দের প্রভাবেই হোলি ও দোল যাত্রা একাত্ম হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু গান, তাঁর ‘সোনারতরী’র ঝুলন, ‘কথা ও কাহিনী’র হোলি খেলাসহ অনেক কবিতায় দোলের প্রসঙ্গ এসেছে। দোলযাত্রা উৎসব শান্তি নিকেতনে বসন্তোৎসব নামে পরিচিত যা কবির জীবদ্দশাতেই উৎসব ও অনুষ্ঠানে, আয়োজনে, সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে।কোথাও কোথাও ফাল্গুন শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে দোল উদযাপন উপলক্ষে ‘বুড়িরঘর’ বা ‘নেড়া’ পোড়ানো হয়। সাধারণত কৃষ্ণ মন্দিরে খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এ বিশেষ বহ্নি উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এই উৎসবটি ছোটদের কাছে বেশি আনন্দদায়ক। তবে সব বয়সের নারীপুরুষই একে অপরকে আবিরের রঙে রাঙিয়ে হোলির আনন্দ নেয়। কম বয়সীরা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। মন্দিরে রাধাগোবিন্দের পূজা অনুষ্ঠিত হয় উলুধ্বনি, কাঁসার ঘণ্টা ও পুরোহিতের ঘণ্টা ধ্বনি সহকারে। কোথাও কোথাও কয়েক দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত ও গুরু চাঁদ চরিতপাঠ, বৈঠকী কীর্তন, হরি সঙ্গিত ও মহাসঙ্গীতের আয়োজন করা হয়। বছরের শেষে নতুন বছরের শুভ কামনায় প্রার্থনা করা হয়। দোলপূর্ণিমার দিনে লালন ফকির তার শিষ্যদের সঙ্গ করতেন। সে অনুসারে আজও কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়ায় দোল উৎসব উদযাপন করা হয়।
উৎসবের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ হয়। শুকনো গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু সংগ্রহ করে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয়। পরের দিন দোলের রঙ খেলা। পশ্চিমবঙ্গে দোলের আগের দিনে হোলিকা দহন হয়, যাকে বলা হয় ‘চাঁচর’ যার অন্য ব্যাখ্যা আছে। বছরের বা ঋতুচক্রের শেষ উৎসব এই দোল। চৈত্রের মোহনায় বৈশাখের আগমনের অপেক্ষা। এই সময় গাছের শুকনো পাতা, ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে যা পুরাতন সকল রুক্ষতা, শুষ্কতা সরিয়ে নতুনের আহ্বান করে। বাংলায় দোলের আগের দিন ‘চাঁচর’কে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়।
অঞ্চল ভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের কিংবা এর সঙ্গে জড়িত লোককথার ভিন্নতা থাকলেও উদযাপনের রীতি এক। ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস, পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করত যা যুগের সাথে রীতির পরিবর্তন করে এসেছে।
দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব যার বর্ণনা নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মীমাংসা’য় পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীর এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’ পালনের বর্ণনা পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’তেও হোলির উল্লেখ আছে। আল বেরুনীর বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোন কোন অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলি উৎসবে সংযুক্ত হত। তাই এই কথা বলা যায় যে অতি সুপ্রাচীন কাল থেকে এই হোলি বা রঙের উৎসব বসন্তের আগমনী সুরের সাথে নতুনের স্বাগত জানিয়ে পুরাতন সব কিছুর বিসর্জন দিয়ে নতুন রঙে জীবন ভরিয়ে দেয়।
দোলের সাথে শান্তি নিকেতন নামটা এখন মিশে গেছে। রং আর আবিরের চেনা রঙিন পরিবেশে সেজে ওঠে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। সকাল থেকেই উৎসবের চেহারা নেয়। ধ্বনিত হয় “ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল।” শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে বসন্তের আগমন উপলক্ষে একটি ছোটো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নাচগান, আবৃত্তি ও নাট্যাভিনয় করা হত। পরবর্তীকালে এই অনুষ্ঠানটি পরিব্যাপ্ত হয়ে শান্তিনিকেতনের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব বসন্তোৎসবের আকার নেয়। সন্ধ্যায় গৌরপ্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের কোনও নাটক মঞ্চস্থ হয়। ভক্তরা এতে অংশ নেন। এই পরিক্রমার দলে থাকে ওষুধ এবং খাবারের গাড়ি। ভক্তরা রাস্তায় পথ চলতে চলতে বিশ্রাম নেন।
সারা ভারত থেকে দোল পূর্ণিমায় গৌরাঙ্গের আবির্ভাব দিবসে রঙিন হতে বিশ্বের ৪৫টি দেশ থেকে নারীপুরুষ নির্বিশেষে ভক্তরা ছুটে আসেন নদীয়ার মায়াপুরের ইসকন মন্দিরে। শান্তির বার্তা নিয়ে মায়াপুর ইস্কনের নগর পরিক্রমা শুরু হয় যেখানে চার দিন ব্যাপী পদযাত্রায় ভক্তরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কীর্তন সহযোগে নবদ্বীপ ও তার আশেপাশের ৭৩ কিলোমিটার পথ পরিক্রমা করে। ইসকন মন্দির কতৃপক্ষের তরফে থাকা খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা থাকলেও উৎসবের দিনগুলোতে অনেক সময় মন্দিরের ভিতরে ঘর নাও পাওয়া যেতে পারে। তাতে অবশ্য কোনও সমস্যা নেই, মন্দিরের বাইরে প্রচুর হোটেল রয়েছে যেখানে থাকা খাওয়ার সব রকম সুব্যবস্থা রয়েছে।