পথ ------ ৪২ ------------------ হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭৮ -- ৭৯ সালে নিত্য পুজো করে পুরোহিতরা দক্ষিণা পেত দশ পয়সা, কুড়ি পয়সা, পঁচিশ পয়সা আবার কোনো কোনো বাড়ি পঞ্চাশ পয়সাও দিত। এটা ওই সময়ের গ্রামের রেট। শহর, মফস্বলের কথা বলতে পারব না। বারোয়ারীতে মূর্তি পুজোর ক্ষেত্রে দক্ষিণা অবশ্যই একটু বেশি। বাবার এই দশ, কুড়ি পয়সা জড়ো করেই রোজকার সংসার চালানো। আমাকে স্কুলে পড়ানো। যে দু'একটা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যেতাম তাদের মাসের টাকাও বাবা এইভাবেই দিত। যদি টাকা দিতে দেরি হয় তাই বাবা তাঁদের সাথে আগেই কথা বলে রাখত। একসাথে একশ টাকা দেখা সেই সময় আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। শুধু আমি কেন, আমার পরিবারের কোনো সদস্যই দেখে নি। একমাত্র দুর্গা পুজোর সময় এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটত। আমরা দু'একটা একশ টাকার নোট দেখতে পেতাম। বাবা দুর্গাপুজো থেকে দক্ষিণা পেত। সঙ্গে আনতো চাল, ডাল, সরষের তেল, কাপড়, গামছা, ফল, সন্দেশ প্রভৃতি। সারাটা বছর শুধু অভাব আর অভাব। নিত্য অভাবের সঙ্গে যাদের দিন কাটাতে হয় তাদের কাছে এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। উৎসব শেষ হয়ে গেলে আমাদের বাড়িতে উৎসব শুরু হত। চাল, ডাল, কাপড়, গামছা দেখে আমাদের সে কী আনন্দ। কয়েকদিন আর আমাদের কোনো চিন্তা নেই। অভাব আর আমাদের চোখ রাঙাবে না। মা চাল, কাপড়, গামছা সব গুছিয়ে রাখত। পুজোয় পাওয়া কাপড়ই মা সারাবছর ধরে পড়ত। বিরাট মূল্যবান কোনো কাপড় নয়। লাল পাড় দেওয়া সাধারণ মানের সাদা শাড়ী। তাই পেয়েই মা কত খুশি। এক সপ্তাহের ভয়ঙ্কর পরিশ্রম নিয়ে বাবা বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাদের আনন্দের ছবি দেখত। পরিবারের মানুষরা খুশি হলে বাড়ির কর্তারা যে কত খুশি হয় তা বাবাকে দেখে বুঝতে পারতাম। সারা বছরের মধ্যে এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। একটা মাস অন্তত আমাদের বাড়ির চারপাশে অভাব ঘেঁষতে পারত না। তার মানে এই নয় যে, পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে রাজার হালে দিন চলে যাওয়া। দু'বেলা দু'মুঠো নিশ্চিন্তের ভাত। আর কিছু না। তবে এটাই সেই সময়ে আমাদের কাছে অনেক। শুধু এই প্রাপ্তির জন্য প্রতি বছর বাবাকে ছেড়ে দিতে হত। তখন কি জানতাম আনন্দের সময়ে বাবার কত বড় সঙ্গ থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ উপায়ও তো ছিল না। বাড়ি ফিরে বাবা কতদিন যে ভালো করে কথা বলতে পারত না। মন্ত্র উচ্চারণ করে বাবার গলায় কী ভীষণ চাপ যে পড়ত। তবুও তার শান্তি। অভাবের ঘরে একটু হলেও তো অন্য বাতাসের ছোঁয়া। ********************