সেই পুরা কাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত এখনো পর্যন্ত নারীরাই দেখতে গেলে ইতিহাস থেকে শুরু করে সকল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে চতুর্দিকে বিছিয়ে রেখেছেন। যদিও নারীকে আমরা অবমাননা এবং অত্যাচারের মধ্যেই লাঞ্ছিত অবস্থায় পুরুষের হাতে দেখতে অভ্যস্ত তবুও এই নারী শক্তি ছাড়া আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোন কিছুই সম্ভব নয়। যেমন মাতৃত্ব ছাড়া সন্তানের জন্ম ধারণ অসম্ভব ঠিক তেমনি এই নারী শক্তির প্রভাবে পৃথিবীতে বিভিন্ন যুগে ইতিহাস রচনা হয়েছে এবং সেই ইতিহাস পরিবর্তিত হয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে নারীরা যুগে যুগে ইতিহাস সমৃদ্ধ করেছেন এবং পৌরাণিক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার হিসাবে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন।
১. শক্তির প্রতীক হিসাবে–
হিন্দু ধর্মে 33 কোটি দেবতার মাঝে দেবী দুর্গা বা কালি শক্তিকে বর্ণনা করবার আলাদা কোনো প্রয়োজন হয় না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল হিন্দু ধর্মের মানুষ এই দুই দেবী শক্তির কাছে মাথা নত করেননি এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয় বরং অসম্ভব। শক্তির প্রতীক হিসাবে দেবীদুর্গা যেমন অশুভ শক্তি ও অসুর বিনাশিনী তেমনই সংহারী রূপে দেবী কালী ও অসুর তথা অশুভ শক্তির বিনাশ করে সাধারণ মানুষের মনে পরমপূজ্য। শুধু তাই নয় এই দুই দেবীর সাথেই আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষে সমগ্র ভারতবাসীর মনে তো বটেই বরং গ্রিসেও বিভিন্ন দেবী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মের মতোই বৌদ্ধরাও দেবীর উপাসনা করতেন। তাই শক্তির, মাতৃশক্তির আরাধনার কথা পাওয়া যায় না এমন ধর্ম বিরল।
২. রামায়ণের ভূমিকায়–
রামায়ণ আদৌ রচনাই হতো না যদি না সেখানে কৈকেয়ী, সীতা ও শুর্পনখা –এই তিন নারী মূর্তির আবির্ভাব হত। শুধুমাত্র সীতা নয়, রামায়ণে অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র ছিলেন কৈকেয়ী যিনি দশরথের কাছে রামচন্দ্রের বনবাসের কামনা করেছিলেন 14 বছরের জন্য। তিনি যদি না থাকতেন তাহলে সীতার সহিত রামচন্দ্র বনবাসে যেতেন না এবং সেখানে বনের মধ্যে কোনোভাবেই শূর্পণখার সাথে লক্ষণ বা রামচন্দ্রের দেখা হতো না। শূর্পণখার নাককাটা যেত না এবং রাগের জ্বালা প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে শূর্পনখা সীতার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার জন্য রাবণের কাছে ছুটতেন না যাতে রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে আসেন এবং তার নাক কাটার অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারেন। সেই জন্য সীতার অপহরণের পর লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছিল এবং অবশেষে রামের হাতে রাবণ বধের পর সীতার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে নতুন ইতিহাস রচনা হয়েছিল যা পরবর্তীকালে রামায়ণ নামে পরিচিত হয়।
৩.মহাভারতের ভূমিকায় —
মহাভারতের সূচনায় দেখা যায় পঞ্চ পাণ্ডবের স্ত্রী হিসাবে দ্রৌপদীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সভামাঝে পাশা খেলায় পরাজিত পাণ্ডব পত্নী দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মাধ্যমে কৌরবরা যদি তাকে অপমান না করতো, তাহলে সমগ্র কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হতো না এবং তার সাথে মহাভারতের মতন এক বিশাল কাব্যরচনা হতোনা। ইতিহাসে বারবার দ্রৌপদীর সাথে মহাভারতের সম্পৃক্ততা ঘোষণা করে যে সেই মহাভারতের যুগে নারীদের অবমাননা কখনোই সহ্য করার মতো ছিল না। তাই নারীর অবমাননা এবং অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্যই একটি বিশাল যুদ্ধের সৃষ্টি হয় যার জন্য মহাভারতের উৎপত্তি এবং সেখান থেকেই ইতিহাসের পটভূমিকার পরিবর্তন হয়।
৪. ট্রয়ের হেলেন–
অসাধারণ রূপ-লাবণ্যের অধিকারিণী অনিন্দ্যসুন্দরী হেলেনের জন্য একটি সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছিল। গ্রীক ও রোমান পুরাণের সর্বাধিক আলোচিত নারীচরিত্র এই হেলেন দেবরাজ জিউস এবং স্পার্টার রাজা টিন্ডারিউসের পত্নী লীডার সন্তান। পরবর্তীকালে স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী ছিলেন হেলেন। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস হেলেনকে নিয়ে স্পার্টা থেকে ট্রয়ে পালিয়ে এসেছিল যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই মেনেলাউস যুদ্ধযাত্রা করে এবং ট্রোজান যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। হেলেনের রূপসৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে গ্রীসের বহু রাজপুত্র তাঁর পাণিপ্রার্থী হলে হেলেন তাঁদের মধ্য থেকে স্পার্টার রাজা মেনেলাউসকে স্বামী হিসেবে বরণ করেন। তাঁর অসাধারণ রূপ-লাবণ্যের কারণে হেলেন দুবার অপহৃত হন। প্রথমবার তাঁকে অপহরণ করেন গ্রীকবীর থিসিউস। কিন্তু আকাডেমসের সহায়তায় হেলেনের দুইভাই ক্যাস্টর ও পলিডিউসিস হেলেনকে উদ্ধার করেন।প্যারিস কর্তৃক হেলেনকে দ্বিতীয়বার অপহরণের ঘটনা থেকেই ট্রয় ও গ্রীসের যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
৫. শেক্সপীয়রের রচনায় নারী–
শেক্সপিয়ারের “merchant of venice” য়ে দেখতে পাই সেই যুগেও তিনি তাঁর রচনায় নারীর যোগ্য মর্যাদা দেবার জন্য পোরশিয়া নামের একটি চরিত্রের বর্ণনা করেন যেখানে পোরশিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে তার হবু স্বামীর বন্ধুকে শুধুমাত্র প্রাণেই রক্ষা করে না নিজে উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় এবং নারীর সম্মান কিভাবে রক্ষা করা যায় তাই বলে দেয়।
ইতালির ভেনিস শহরের সওদাগর অ্যান্টনিও যে সকলের কাছে অত্যন্ত ভাল আর এক ব্যবসায়ী শাইলক-নীতিহীন, সুদখোর, কুটবুদ্ধিসম্পন্ন। কেউ তাকে পছন্দ করেনা। সে অ্যান্টিনিওকে হিংসা করত। অ্যান্টানিওর ঘনিষ্ট বন্ধু বাসানিও টাকার অভাবে পোরশিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারছে না। অবশেষে অ্যান্টনিও বন্ধুর মনোবাসনা পূরণ করতে শাইলকের কাছে টাকা ধার করে। তবে শর্ত থাকে যদি অ্যান্টিনিও সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারে তবে তার এক পাউন্ড মাংস কেটে দিতে হবে। টাকা পাওয়ার সময়সীমা পার হওয়ায় শাইলক অ্যান্টিনিওর শরীর থেকে এক পাউন্ড মাংস দাবী করে। বিচারক অনুরোধ করলেও শাইলক অনমনীয়তা বজায় রাখে। খবরটা পোরশিয়াকে বিচলিত করে অ্যান্টিনিওর বিচারকার্যে এক তরুন উকিলের ছদ্মবেশে পোরশিয়া বিচারকের কাছে বলে শাইলককে অ্যান্টিনিওর শরীর থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে বলে কিন্তু রক্তপাত ছাড়া। কারণ রক্তের কথা দলিলে উল্লেখ ছিলনা। রক্তপাতহীন মাংস কাটা অসম্ভব। ধূর্ত শাইলক বিপদে পড়ে যায় এবং অবশেষে বিচারে পরাজয় স্বীকার করে।
এভাবেই দেখতে পাওয়া যায় যুগে যুগে বিভিন্ন ঘটনাবলীর মাধ্যমে নারীর সম্মান এবং নারীর অহংকার রক্ষার জন্য বিভিন্নভাবে ইতিহাসের দিক পরিবর্তন হয়েছে এবং নারীদের সম্মান রক্ষার্থে ইতিহাসের পটভূমিকার পরিবর্তনে যুদ্ধের সৃষ্টি হয়েছে। নারীর বুদ্ধিমত্তা, সাহস, ব্যক্তিত্ব, অহংকার এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব যে কোনো অংশে পুরুষের থেকে কম নয় আজকের যুগে তাই প্রমাণিত।