শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সটা হয়েই গেলো --মিউচুয়াল ডিভোর্স , না কিছু দাবি করিনি তোমার কাছে....,যদিও তোমার বৈভব ,প্রাচুর্য কম কিছু ছিলো না ,চাইলে দু -এক মুঠো ভিক্ষে আমাকে দিতেই পারতে !তবু নিজেকে আর ছোট করতে চাইনি ---,সই টা হয়ে যাবার পর তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম একবার চোখের জল আটকিয়ে বলেছিলাম ভালো থেকো...যদিও কোন উত্তর দাওনি তুমি ,চলে গিয়েছিলে....। হাঁ সেই কিছুটা মুহুর্ত পের করা খুবই কঠিন হয়েছিলো ,পেটের তাগিদ পেট তো কোনো কথা শোনে না ,কাজের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি...কত নোংরা প্রস্তাব -কুৎসা -....কত আড়চোখের দৃষ্টি -অসম্ভব মনে হয়েছিলো বেঁচে থাকা...তবু হার মানিনি লড়ে গেছি ,শেষে অনেক কষ্টে একটা ওল্ড হোমে কাজ জোটে ,থাকা- খাওয়া আর ওই বৃদ্ধ মানুষ গুলোর দেখাশোনা --মন্দ লাগেনি একটা হিল্লে হলো নিজের , কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারলাম কই -একদিন ফেসবুক এ অন্য নামে একটা আকাউন্ট খুলি ,খুব আনন্দ হয়েছিলো তোমাকে খুঁজে পেয়ে ,মাঝে মধ্যে কথাও হত -না নিজের অতীত জীবনের কথা কখন বলনি আমাকে -আমার কথা জানতে চেয়েছ অনেকবার -ছবি চেয়েছ দেখতে ,ফোন নম্বর -এড়িয়ে গেছি ,তুমি একটিবারের জন্যও বুঝতে পারনি আমি তোমার সেই তিথি.....কলেজ -প্রেম -বিয়ে -ডিভোর্স কত কাহিনী । একদিন কথায় কথায় বললে বিয়ে করছ , না আশ্চর্য হয়নি --কিন্তু একটা ক্ষীণ আশা নিভে গেল যেন ,যা একান্ত নিজের ছিলো তাকে পর হতে দেখলে কি হয় বোঝাতে পারব না -তবে তার থেকে বেশি কষ্টের আর হয়ত কিছু হয় না । শেষে একদিন ধুমধাম করে আবার বিয়ে করলে --ছবি পোস্ট করলে ,আমি কামেংট করেছিলাম তোমার বউ খুব সুন্দরী ,তারপর সেই মধুচন্দ্রিমা আচ্ছা তোমার কি সেই রাতে তোমার তিথির মুখটা একবারও মনে পড়েনি ?? অনেক দূরে অন্যকোনো প্রান্তে অমাবস্যার কালো অন্ধকারে বসে কি ভীষণ অভিশপ্ত সেই কান্না কেঁদেছিলাম --তুমি কি একবারও জানতে চেয়েছিলে ? তারপর থেকে রোজ নিয়ম করে আর কথা হত না....,তবে মাঝে মাঝে তোমার মন গেলে কথা বলতে -তোমাদের হানিমুন ,সংসার সব গল্পই আমার চোখের সামনে দিয়ে এগোতে লাগলো ,একদিন তোমার সন্তান আশার গল্পও বললে....আর যেদিন তোমার কোলে ছোট্ট আর একটা তোমাকে দেখলাম কি ভীষণ আনন্দ হয়েছিলো আমার বোঝাতে পারব না...যেনো আমারই সন্তান -আমার....আমার ,না না তোমার তোমাদের.....। অবশেষে একদিন তোমার বউ এর আমার সঙ্গে কথা বলার আপত্তির কথা জানালে আর কিছুই না বলে ব্লক ও করে দিলে ! খুব রাগ হয়েছিলো জান -অন্য কারো কথা তুমি কোনদিন ভাবনি কোনদিন না --,এতোগুলো দিনে একবারও তোমার তিথির কথা বলেছিলে আমাকে ?অথচ এই তিথি তোমার জীবনের একটা অঙ্গ ছিলো...। আর কখন তোমাকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করিনি ---অনেকগুলো বছর পার হয়ে গিয়েছিলো ,কাঁচা চুলে কখন পাকা রঙ ধরেছিলো বুঝতে পারিনি ,আর কোনদিন কোনো জোৎস্নার আলো আমাকে ভেজায়নি , শুধু বয়সটা সীমারেখা পার করে কোথায় যে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো কে জানে...,দেখতে দেখতে আমি ও এক বয়স্কা নারী হয়ে উঠেছিলাম । এখন আমিও এই ওল্ড হোমের এক বয়স্ক মেংবর । সেদিন এক নতুন মানুষ এসেছেন শুনে ভাবলাম যাই আলাপটা সেরে আসি - কিন্তু এ আমি কাকে দেখছি...চশমাটা পরিষ্কার করে নিলাম একবার ,পায়ের তলার মাটি কেমন যেনো নড়ে যাচ্ছিল , প্রায় দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর... না আর একটু বেশিই হবে , কেমন চেহারা হয়ে গেছে মানুষটার -সব চুল পাকা --খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি -নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । জিগ্যেস করলাম কেমন আছ ? স্ত্রীর মৃত্যুর কথা বললে -বললে একমাত্র ছেলে বিয়ে করে বিদেশে সেটেল্ড -আর তুমি বেশ কিছু টাকা ভারী ডোনেশন দিয়ে বাকি জীবনটা এইখানে কাটাবে বলে চলে এসেছ। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি ,কিন্তু আজও আমাদের মত বয়স্ক মানুষের একটা অংশ এই ওল্ড হোম গুলিতে কাটায় অবাক লাগলেও এটাই সত্যি ---ফেলে আশা ,ছুঁয়ে আশা মুহূর্ত গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো ,তুমি একদৃষ্টি আমার সিঁথির সিঁদুরের দিকে তাকিয়ে রইলে...,মনে মনে বললাম অল্পকরে আজও ওইটুকু রেখেছি..বলতে পার ফেলতে পারিনি ,জীবনে পুরুষ মানুষ বলতে যাকে চিনেছি সেটা শুধুই তুমি । নিজের রুমে ফিরে নিজের সাথে নিজের এক অদ্ভুত বোঝাপোড়ায় মেতে উঠলাম....আজ এত গুলো বছর পড়ে জীবনের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে কান্না কিছুতেই বেগ মানতে চাইলো না ॥ ॥ বৈশাখী চ্যাটার্জীঃ ৩রা এপ্রিল ২০১৭