আঘোরী বাবার সন্ধানে বারানসীঃ অপর্ণা দেব

আঘোরী বাবার সন্ধানে বারানসীঃ অপর্ণা দেব

 

মার সাথে কালী মন্দিরে প্রায়ই যাওয়া হয়, সেখানে এক বিশাল বট বৃক্ষ আর সেই গাছের নীচে এক লাল কাপড় পরা সাধু বাবাকে দেখতাম। উনি কেবল এক মনে বসে থাকতেন। কালী পূজার রাত্রিতেও মা বাবার সাথে গিয়েছিলাম মন্দিরে, কিন্তু সেই দিন সেই সাধু বাবাকে দেখতে পায়নি। এর বেশকিছুদিন বাদে আবার যখন গেলাম তখন ওনাকে সেই বট গাছের তলায় দেখতে পেলাম কিন্তু ওনাকে দেখে তখন খুবই ভয় পেয়ে গেলাম..ওনার হাতে তখন এক নর মুণ্ড, চোখ দুটো যেন লাল, এক অলৌকিক তেজ দেখতে পেরেছিলাম ওনার মুখমণ্ডলে। মন্দিরের ঠাকুর মশাই এর মুখে শুনলাম উনি নাকি ‘অঘোরী’ বাবা। তাই তো, আমাদের কলকাতার নিম তলার শশ্মানেও প্রতিবছর দীপাবলির সময় এমনই কিছু অঘোরী সাধুদের তন্ত্র সাধনা করতে দেখা যায়, কিন্তু ওরা কোথায় থেকে আসছে তা কারোরই জানা নেই। সেই থেকেই ওদের কে চেনার জানার এক প্রবল ইচ্ছে মনের মধ্যে চেপে বসল। আর সেই ইচ্ছের টানেই পৌঁছলাম বারানসীতে।

বারানসীর গাঙ্গার ধারে ঘুরছি, ঠিক ঘুরছি না খুঁজছি। প্রায় খানিকটা হাঁটার পর এসে পৌঁছলাম শশ্মান ঘাটে। সেখানে  এক বয়স্কা মহিলার মৃত দেহ রয়েছে চিতায়, কিছু লোক স্বল্প কাঠ দিয়ে সেই মৃতদেহে মুখগ্নি করে আর খানিকবাদেই আগুন নিভিয়ে মৃতদেহটিকে ফেলে দেয় গঙ্গায়। আর ঠিক তখনই সাথে সাথে কোথায় থেকে কাল কাপড় পড়া এক সাধুবাবা ছুটে আসেন এবং মৃতদেহটিকে তুলেনেন নিজের কাঁধে। কিছুটা আন্দাজ করেই আমিও পিছু নিলাম ওনার। শশ্মানের আরেক কোণায় ছিল ওনার আস্তানা। এবার ওনার সাথেই আমিও এসে পড়লাম সেই আস্তানায়, লোকটা আমাকে দেখছেন তবুও আমি জেন অদৃশ্য হয়ে রয়েছি ওনার কাছে, আমার কৌতূহল ক্রমশ বেড়েই চলছে কিন্তু বুকের ভিতর হচ্ছিল একটা চাপা ভয়। উনি মৃতদেহটিকে স্বযত্নে  রাখলেন। কি করবেন উনি এখন!!! কাউকে তো এতদিন দেখেনি এইভাবে কোন মরা লাশ নিয়ে আসতে। আবার এইদিকে যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতে চলছে। অনেকটা সাহস জুগিয়ে ওনাকে জিগ্যেস করলাম, “আমি কি কিছু কথা বলতে পারি”,খুব শান্ত গলায় উনি বললেন, “আমাকে জানতে এসেছিস বুঝি, কিন্তু আমি তো কেউ নয়ই, আমিতো অঘোরী” কথাটি বলেই উনি চোখ বুজে ধ্যান মগ্ন হয়ে গেলেন। আমার থাকা বা না থাকা কোন কিছুতে ওনার আপত্তি নেই। আমিও চুপটি করে বসে রইলাম। রাত কিছুটা গড়াবার পর যা দেখলাম তা মনে করলে আজও গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। সেই মৃতদেহের পাশে অগ্নি জ্বালিয়ে অঘোরী বাবা যজ্ঞ করতে বসলেন, ওনার এক হাতে ছিল এক নর কঙ্কাল হাড় ও অন্য হাতে কারণবারি। অগ্নির চারিদিকে ঘুরছেন, ঘুরতে ঘুরতে মৃতদেহটির উপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন, জপ করে জাচ্ছেন কিছু মন্ত্র চোখ দুটো দেখাছিল লাল রক্তাভ। মৃতদেহটির মুখে ডেলে জাচ্ছিলেন কারণ। খনিক বাদে হাতে খড়গ নিয়ে বসে পড়লেন। আর নির্বিকারে কেটে ফেলেন সেই মৃতদেহের মস্তিষ্ক। সেই পরিস্থিতিতে ওখানে বসে থাকার ক্ষমতা আমার আর রইল না, চলে এলাম শশ্মান থেকে। পরদিন সকাল হতে না হতেই আবার ছুটে গেলাম সেই শশ্মানে। বেশ কয়েকবার অনুরধের পর অঘোরী বাবা আমার সামনে তুলে ধরলেন “অঘোরী”র প্রকৃত রূপ :

মানুষের জীবনে সবচেয়ে রহস্যময় তার হৃদয় বা মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্কের এক অদ্ভুত মানসিকতায় বশীভূত হয়ে কিছু কিছু মানুষ তার স্বাভাবিক  জীবনযাত্রাকে ত্যাগ করে বেঁছে নিচ্ছে কঠোর অঘোরপন্থাকে, এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানও একে পুরোপুরি ভাবে অস্বীকার করতে পারছে না!!  এই অঘোর পন্থার সঠিক উৎপত্তি কাল ঠিক কবে তা কাউর জানা নেই, তবে এদেরকে ভগবান শিবের সাধক বলা হয়ে থাকে।

প্রাচীন হিন্দু ধর্ম অনুসারে অঘোরীদেরকে পৃথিবীতে ভগবান শিবের জীবিত রূপ হিসেবে মানা হয়ে থাকে। শিব ঠাকুরের পাঁচ রূপের মধ্যে এক রূপ ছিল অঘোর রূপ। এদের জীবন প্রক্রিয়া যেমন কঠিন তেমনই রহস্যময়।

অঘোর কথাটির অর্থ হল যার কোন ঘোর নেই বা যা খুবই সহজ সরল। যাদের মনে কোন ভেদাভেদ থাকে না। এই জগতের কোন জীবিত বা মৃত, কোন প্রাণী বা বস্তু, মানুষ বা জন্তু জানোয়ার কোন কিছুর মধ্যেই ভেদাভেদ করে না।  ওদের মতে  সমগ্র পৃথিবী ওদের বাসস্থান আর এর সবকিছুই ওদের খাদ্য, পানীয়, এমনকি ওরা যেকোনো মৃত জীব বা জানোয়ারের মাংসকেও কোন সুস্বাদু খাবার রূপে খায়। অনেকের মতে এই সাধু বাবারা কাউর উপর নাকি প্রসন্ন হলে দুহাত ভরে তাকে আশীর্বাদ করেন, আবার অঘোরীদের সম্বন্ধে রয়েছে এমন কিছু অজানা রহস্য ও ভয়ঙ্কর তথ্য যা জানলে হয়ত আপনার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠবে!!

 

 

অঘোরীরা মূলত তিন প্রকার সাধনা করে থাকেন। শিব সাধনা, শব সাধনা এবং শশ্মান সাধনা। শিব সাধনার মূলরূপ হল মা কালীর দ্বারা শিব ঠাকুরের বুকের উপর পা রাখা, তাই এই সাধনা অঘোরীরা মৃতদেহের উপর দাড়িয়ে করে থাকেন। আর প্রসাদ রূপে মৃত দেহকে দেওয়া হয় মাংস ও মদিরা। শব সাধনা, যার জন্য প্রয়োজন মৃত দেহের। কিন্তু কোথায় পাবেন মৃত দেহ! কিছু প্রথা অনুযায়ী আজও যদি কোন পাঁচ বছরের ছোট শিশুর বা সাঁপে কামরে অথবা কেউ যদি আত্মহত্যা করে তবে তার দেহকে দাহ না করে আমরা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেই অথবা কবর দেই। আর অঘোরী সাধুরা এমনই কোন মৃত দেহকে নিয়ে যান নিজের তন্ত্র সিদ্ধি বা শব সাধনার জন্য। শশ্মান সাধনাতে ওনারা সাধারণত গঙ্গা জল দিয়ে শশ্মানের পূজা করে থাকেন।

 

দেখতেও অঘোরী সাধুরা হন কিছুটা অদ্ভুত। এদের চোখ দুটো হয় লাল,সমগ্র শরীরে মাখানো থাকে মৃতদেহের ভস্ম, কপালে থাকে লাল টিকা, অর্ধ নগ্ন রূপে অথবা কাল বা লাল বস্ত্র পরিধানে গলায় থাকে ধাতু নির্মিত নর মুণ্ডের মালা। এবং থাকে কিছু নর কঙ্কাল ও এক নর মুণ্ড। গো মাংস ছাড়া এরা খাচ্ছে বাকি সবকিছু। মানব মল -মূত্র থেকে শুরু করে মৃত মানব দেহ ও জন্তু জানোয়ারের মাংসও। এদের মন থেকে দূর হয়ে যায় সব ঘৃণা- দ্বেষ তাই তো এরা তৃষার্ত অবস্থায় পান করে নেয় নিজেদের মূত্র টুকুও। শশ্মান সাধনাই হল অঘোরীদের মূল সাধনা তাই অধিকাংশ সময় ওনারা শশ্মানেই কাটান। অনেক কম লোকদেরই এটা জানা যে অঘোরীদের সাধনাতে নাকি এত শক্তি থাকে যে ওরা মৃতদেহের আত্মার সাথেও কথা বলতে পারে, ওনাদের মতে যখন  চিতা জ্বালানো হয় তখন মৃত ব্যক্তির আত্মা তার আশেপাশেই থাকে, তন্ত্র সাধনার দ্বারা এরা পর শক্তিকেও নিজেদের বশে করতে পারে। এই সাধনা শশ্মানেই হয়ে থাকে, ভারতে এমনই চারটি প্রসিদ্ধ শস্মান আছে যেখানে অঘোরীদের তন্ত্র সাধনার দ্রুত ফল পাওয়া যায়- পশ্চিম বাংলার তারাপীঠ শশ্মান, আসামের কামাখ্যা পীঠের শশ্মান, নাসিকের ত্রম্বকেশ্বর ও মধ্যপ্রদেশ উজ্জয়ন এর শশ্মান।

 

 

তারাপীঠ :

পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলায় অবস্থিত এই তারাপীঠ মন্দির। পৌরাণিক মতে মা কালীর নেত্র পড়েছিল এইখানে, তাই নয়ন তারা মন্দিরও বলা হয়ে থাকে। মন্দিরের পাশেই রয়েছে মহাশশ্মান ঘাট। আর এই শশ্মান ঘাটের চিতার অগ্নি কখনো নিভে না, তাই অঘোরীরা সাধনার জন্য চলে আসেন এই মহাশশ্মানে।

 

কামাখ্যা পীঠ :

আসামের রাজধানী দিসপুর থেকে প্রায় ৮কিমি দূরে নীলাচল পাহাড়ে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দির প্রাচীন কাল থেকেই তন্ত্র সাধনার শ্রেষ্ঠ স্থান। এখানে দেবী সতীর গর্ভ এবং যনি পড়েছিল, তাই দেবীর শক্তিপীঠের মধ্যে এই শক্তিপীঠের রয়েছে খুব মহত্য।  পৌরাণিক গ্রন্থ অনুসারে কাম দেবতা এক শাপের জন্য নিজের পুরুষত্ব হারিয়ে ফেলেন এবং পরে দেবী শক্তির জননাঙ্গ ও গর্ভের মধ্যে দিয়েই উনি শাপ মুক্তি হতে পেরেছিলেন, আর তখন থেকেই এই মন্দিরের নাম হয় ‘কামাখ্যা’ মন্দির। মন্দিরের গর্ভ গৃহে রয়েছে দেবীর গর্ভ ও যনি, আর প্রতি বছর জুন মাসে তিনদিনের জন্য এখান থেকে বের হয় রক্ত।

বড় মেলা বসে, দূর দূর থেকে ভক্তরা আসেন নিজেদের প্রার্থনা নিয়ে। আর এই সময়টাই হল তন্ত্র সাধনার সবচাইতে উপযুক্ত সময়। অঘোরীদের মতে এই সময়টাতে সাধনা করলে খুব সহজেই দেবীমা কে প্রসন্ন করা যায় আর যার ফলসরূপ অঘোরীরা হয়ে উঠতে পারে সর্ব শক্তিমান।

 

 

নাসিক :

 

 

মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলায় অবস্থিত ত্রম্বকেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ। ব্রহ্ম গিরি পর্বতে অবস্থিত এই মন্দিরে ভিতরে রয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের ছোট ছোট লিঙ্গ। এই মন্দিরকে ভগবান শিবের অন্যতম প্রধান মন্দির হিসাবে মানা হয়ে থাকে। শিব হলেন তন্ত্র শাস্ত্রের দেবতা। তন্ত্র ও অঘরবাদের জন্মদাতা ভগবান শিবকে মানা হয়ে থাকে। তাই এইখানে অবস্থিত শশ্মান তন্ত্র কার্যের জন্য প্রসিদ্ধ। অঘোরীরা সমগ্র শরীরে ভস্ম মেখে নর কঙ্কাল, হাতে নর মুণ্ড নিয়ে জলন্ত চিতার সামনে বসে পান করেন নর রক্ত। আর হারিয়ে যান গভীর সাধনায়।

 

 

উজ্জয়ন :

মধ্য প্রদেশের উজ্জয়ন জেলায় অবস্থিত মহাকালেশ্বর মন্দির ১২ টি জ্যোতিরলিঙ্গের মধ্যে অন্যতম। স্বয়ংভু, ভব্য ও দক্ষিণমুখী হওয়ার জন্য মহাকালেশ্বরের মহাদেবের মন্দিরকে খুবই পুন্যদায়ি মন্দির হিসেবে মানা হয়ে থাকে। সেই কারনে তন্ত্র শাস্ত্রেও এখানে খুব শীঘ্র ফল পাওয়া যায় বলে ধারণা। এখানের শশ্মানে বহু দূর দূর থেকে অঘোরীরা তন্ত্র সাধনার জন্য এসে থাকেন।

 

 

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here