Home ব্লগবাজি উদযাপনের বাংলা ভাষা ~ সোমাদ্রি সাহা

উদযাপনের বাংলা ভাষা ~ সোমাদ্রি সাহা

উদযাপনের বাংলা ভাষা  ~    সোমাদ্রি সাহা

উদযাপনের বাংলা ভাষা – সোমাদ্রি সাহা

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

আর পাঁচটা দিনের মতো আজও অফিস, ফেবু করে কেটে যাবে বাঙালির দিন। বলব হয়তো মুখ দিয়ে ভাষায় কথা। বাংলা ভাষায়। বুঝব না কতটা ঋণ। অর্জিত ভাষা। পৃথিবীর একমাত্র অর্জিত ভাষা। এই চেতনাটুকু বুঝতেই হবে কারণ আমরা তো ইমোশানাল ফুল। মধ্যমেধার বাঙালিরা সারাজীবন লোকের কথা শুনেই জীবন কাটালাম। দস্তুর।

আজ উনিশে মে। আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যদিও জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বাংলাভাষী। বরাক উপত্যকায়, বাংলাভাষী জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রধান ঘটনাটি ১৯৬১ সালের ১৯ মে ঘটে, সেদিন ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচরে প্রাদেশিক পুলিশ হত্যা করে। ইতিহাস সকলে যদি না জানেন, তা তো আমাদেরই লজ্জা। একটু ফেবু কম করে উইকিপিডিয়া পড়ুন…বাংলা ভাষার অর্জনের ইতিহাসগুলো জানুন।

আমরা নিজেরা ভেবেও দেখি না সেভাবে। এটুকুই নিয়ম। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা পড়া বাধ্যতামূলক, এতেই খুশি। তারপর। তারপর নিজের দিকে আয়নায় তাকিয়ে ভাবব না কোথায় গেল আমার ব্যাকরণ। আমি নিজে কতটা মনে রাখতে পেরেছি। আমি মাতৃভাষা পুরোপুরি মনে রাখতে পারিনি। কারণ আমিও বাংলা ভাষাকে ভালবাসতে পারিনি। আমি শুধু রুটিরুজির জন্য শিখে নিয়েছি সবটুকু। এখানেই শেষ। এখানেই আমাদের সবটুকু শেষ। ভালবাসার অনন্য এক আবেদন বাংলা ভাষার রয়েছে। উনিশে মে তারই মোমবাতি দিন। স্মরণ করাটাই দরকার। আমরা এখন বাহুবলীর ফ্যান্টাসীতে বাঁচতে শিখেছি, রাত জেগে ছয় ওভারে জিতটা দেখতে শিখেছি, ভাষাকে নিয়ে কাঁদতে ভুলে গেছি। যতই বলি গুপি বাঘার নস্টাল, আসলে আমরা তো শিখে নিয়ে তিন নম্বরী, চার নম্বরী। সেদিনও ভাষার অন্তরে ঘুণ পোকা ছিল আজও আছে। তাকবেই। সাহিত্যের সাধনা তো সকলকে ব্রহ্ম চেতনে উপনিত করতে পারে না। এটাই বুঝতে হবে।

ভাষা আসলে চমস্কির কথায় রিপয়েটরে থাকে। আমরা ভাষা নিয়ে জন্মাই। কিন্তু লালন পালন কতটা করি। আজও কী মোমবাতি নিয়ে যেখানে উনিশে মে স্মরণ করা হবে, সেখানে ভাবা হবে যে কী হতে পারে এই ভাষার কান্না। ভাবা হবে না। বাঙালিরা আটপৌড়ে দেখাতে পছন্দ করে। সংস্কৃতির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম এখন কমেছে। কারণ বাহক ভাষার মানুষ কমছে। প্রতিদিন যেখানে ভাষার মৃত্যু হচ্ছে সেখানে বাংলা ভাষা থাকবে। চিরকালীন। কারণ এই ভাষা সর্বদা গ্রহণ করতে জানে। আমার লেখাতেও ইংরেজি ফার্সি শব্দ পাবেন। কারণ এই ভাষা এক বিরাট ব্ল্যাক হোল। সবটুকু নেয়। তা বেশ, নিক তবে ভাষা যেন মান বজায় রাখে। আরে শালা শব্দটি তো রামকেষ্টও বলতেন। তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু সমাজকে ভাষা যেন কুরুচীতে না পৌঁছে দেয়। এটুকুই বেঁচে থাকা। ভাষার জন্য এটুকুই আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক। আমি ভুল বানান লিখি। আমিও তো রক্তমাংসের মানুষ। জেনেশুনে ভুল করি না। চেষ্টা করি শুদ্ধ লেখার। এখনকার ফেবু যুগে সকলে সাহিত্যিক হতে পারেন কিন্তু ভাষাময় হতে পারবেন না। ভাষার নিজস্ব ছন্দ আছে। মিষ্টতার সাগর তো বিদ্যাসাগর দিয়েছিলেন, সেই চেতনার দ্যুতিকে বুঝতে হবে। তবেই এগিয়ে চলার পথে পাথেয় হবে জীব চেতনা। জীবনের পাথেয় ভালবাসা। আর ভাষা সে পাথেয় পরমান্ন দিতে পারে। আমরা পরমহংস না হতে পারি, দুধ কতটা ঘন সেটা যেন বলতে পারি। ভাষার মান বজায় রাখার জন্য এই মুহূর্তে যে সাহিত্য প্রয়োজন তা আমাদের উদ্ধার করতেই হবে। এটাই আমাদের সকলে সংকল্প হওয়া উচিত।

এই যে প্রথম শ্রেণি থেকেই বাংলা ভাষা শেখা, তা হয়তো আমাদের চাকরি দেবে না কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কিন্তু আমাদের নতুন করে বাঁচতে শেখাবে। কারণ মাতৃভাষাই জাতির ক্রমমুক্তি দিতে পারে। বিদেশি ভাষার দাসত্ব করে এমএনসি হওয়া যায়, কিন্তু মা ডাকের মধ্যে যে শান্তি আছে তা কোটি টাকাও দিতে পারে না। তাই জন্য বাংলা ভাষার চেতনা দরকার। এখনকার ছাত্রছাত্রীরা বাংলা হিন্দি ইংরেজি কোনও ভাষাতেই ভাল করে দরখাস্ত লিখতে পারে না কারণ তাদের ভাষার প্রতি টান নেই। তাই বাংলা ভাষার রস তারা সত্যই পেল না। আজও কতজন ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার সাথে লিখতে পারেন, মানতে পারেন টেনস, ভাওয়েল, ফ্রেজ ইত্যাদি জানা নেই। ঐ যে বললাম নোট পড়ে মোটা টাকার স্কুল ফি ও প্রাইভেট টিউটরকে দিয়ে কিনে নেয় সার্টিফিকেট। মাইক্রো জেরক্স করে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিতে পোস্তার মতো ফ্লাইওভার ভেঙে যেতেই পারে। আসলে সমাজ চলে এখন ম্যানেজ করে। তাই ভাষাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার সময় নেই সমাজের। সময় এখনও আছে, সময় এখনও সবটুকু দেখছে। সংস্কৃতির চরম এখনও উপস্থিত। এগিয়ে চলার ভাবনারা এখন প্রস্তুত। বুঝতেই হবে। ভাষা চেতনার প্রসঙ্গে মনে এলো কিছু রবি ঠাকুরের লাইন, খুঁজে বের করলাম সেই লাইনগুলি। –

‘মাতৃভাষা বাংলা বলিয়াই কি বাঙালিকে দন্ড দিতেই হইবে? এই অজ্ঞানকৃত অপরাধের জন্য সে চিরকাল অজ্ঞান হইয়া থাক্, সমস্ত বাঙালির প্রতি কয়জন শিক্ষিত বাঙালির এই রায়ই কি বহাল রহিল? যে বেচারা বাংলা বলে সেই কি আধুনিক মনুসংহিতার শূদ্র? তার কানে উচ্চশিক্ষার মন্ত্র চলিবে না?’ আমার কাছে এখন ইংরেজি চলচ্চিত্রের অনেক বিষয় দুর্বোধ্য। যখন হাল্কা আওয়াজে কথা বলে বুঝি না। দেশটা এখন তৃতীয় বিশ্ব। এখনও জনসাধারণ দিশাহারা হয়। কারণ দামী স্কুল কলেজে শিক্ষার মুক্তি যজ্ঞে বাংলা ভাষা নেই। সেখানে সমস্ত ইংরেজি। সে থাকুক। আমার কথা হল একটি ভাষা যদি আমরা ভাল করে রপ্ত করতে পারি, তাহলে অন্য ভাষারা ধীরে ধীরে আমাদের অজ্ঞতাকে দূর করবে। বাংলা ভাষার সেই জোর আছে। এটাই বেচে থাকার ভাষা। আমাদের নানা কাজে, নানা ভাবনায় বাংলা ভাষাই মনোবিজয়ের পথ দেখাতে পারে। এই ভাষায় নবজাগরণের এক গন্ধ রয়েছে। যা পরবর্তী জীবনে সকলকে সাহায্য করবে এগিয়ে যেতে। তাই যারা বলেন আমার সন্তান বাংলা টাংলা জানে না, মুখে যোগাযোগের জন্য বলতে পারে তাদের বলি, বীজ লাগালেই গাছ হয় না। চারা গাছ ভাল করে যত্ন করতে হয়। তবে তা ধীরে ধীরে মহীরূঢ় হয়। বাংলা ভাষার নিজস্ব এক যত্ন আছে। এই ভাষার সাহিত্যের বিশাল সম্ভার রয়েছে। রয়েছে বেঁচে থাকার অনন্য এক সত্তা। আমরা বাড়িতে তো বাংলা বলি। ইংরেজি শব্দরা সেখানে কম। যে বাড়িতে বাংলায় কথা বলব সেখানে স্কুলে গিয়ে জানতে হবে ফটোসিন্থেসিস…কেন আমরা সালোকসংশ্লেষ শব্দটি জানব না। কঠিন তো সবটুকুই। ল্যাটিন শব্দে ইংরেজি লিখে দেখেছেন। তেমনই বাংলা ভাষার কিছু কঠিন উচ্চারণ শিখলে বুঝবেন কতটা সহজ। অন্তত পিসি চলো যাই-কে সাইকোলজি বলতে হবে না। (মজা করলাম) বাংলা ভাষার জন্মযাপনে রয়েছে নির্মল প্রভাত, সুন্দর এক সন্ধ্যা। পরিযায়ী পাখিরা যতই আমাদের দেশে আসুক সাইবেরিয়া থেকে, ফিরে যায়। এটাই বলার। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার সমস্যা আছে জানি। আগেও ছিল। তবু তখন ইংরেজিও জানতেন ছাত্রছাত্রীরা। যারা শেখার ঐ বাংলা মাধ্যমে পড়েও তারা শিখেছেন। বিদেশ গেছেন। ভীত শক্ত হলে বাংলা ভাষার গন্ধটা পুরো পেলে কার্বাইটের ইংরেজি দরকার হয় না। গাছ পাকা আমের দাম আজও কিছুটা বেশি। মশাই সকলকেই তাই এই ভাষার গন্ধটা ভাল করে শুকতেই হবে। আরও বাংলা পত্র পত্রিকা, লিটিল ম্যাগ, কবিতার বই, গল্পের বই কিনতে হবে ও উপহার দিতে হবে। বাংলা ভাষায় ফিরে আপনাকে আসতেই হবে। কেন মশাই যখন রেগে ঝগড়া করেন সব কী ইংরেজিতে গালি দেন নাকি সকলে। বাংলা আসে না। মাতৃভাষা, বিশেষ করে বাংলা ভাষার আলাদা ম্যাজিক আছে। এটা কেও আলাদা করে বোঝাতে পারবে না। জীবনের টাইটানিক এক সময় ঢুববে। তবু বাংলা ভাষার পথ ধরে চললে রক্তে থাকা বিদ্যারা একদিন হয়তো আপনার উত্তরসুরীদের বলবে – ‘মাতৃভাষাক অপবাদ দূর হোক, যুগশিক্ষার উদ্বেল ধারা বাঙালিচিত্তের শুষ্ক নদীর রিক্ত পথে বান ডাকিয়ে বয়ে যাক, দুই কূল জাগুক পূর্ণ চেতনায়, ঘাটে ঘাটে উঠুক আনন্দ-ধ্বনি।’

  সোমাদ্রি: ১৯ শে মে, ২০১৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here