পথ ----- ১৪ ---------------- হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বাড়ি থেকে ঠিক পাঁচ মিনিট দূরত্বে একটা পুকুর ছিল। নাম পানপুকুর। বাড়ির পিছন দিক দিয়ে যেতে হতো। পুকুরটার চারপাশ গাছপালা দিয়ে ঘেরা। কি গাছ ছিল না সেখানে। সব মিলিয়ে একটা বিরাট বাগান। পুকুরটার চারপাশে এত গাছ ছিল যে, জলে সরাসরি সূর্যের আলো এসে পড়ত না। জলটা সবসময় কালো হয়ে থাকত। আর কি ঠান্ডা জল ! পানপুকুর যেতে গেলে একটা আনারসের বাগান পেরিয়ে তবে যেতে হতো। মাঝখান দিয়ে সরু একটা পথ। আনারসের বাগান মানে সেখানে সাপ থাকবেই। ওই বাগানেও ছিল সাপের রাজত্ব। বাগানের ওই রাস্তা দিয়ে বেশিরভাগ সময়েই ছুটে যেতাম। যদি সাপের মুখে পড়ি, সে যাতে আমার সঙ্গে ছুটে পাল্লা দিতে না পারে তাই এরকম করতাম। এসবই ছিল ডাক্তার দাদুদের সম্পত্তি। খুব ছোটবেলায় দাদুকে দেখেছিলাম। বাবার মুখে শুনেছি তিনি একসময় ধনেখালির খুব নামকরা ডাক্তার ছিলেন। ঘোড়ায় চড়ে রোগী দেখতে যেতেন। খুব বড় আনারসের বাগান। গোটা বাগানটা ছিল আনারসে ভর্তি। আর বাগানের ধারে ধারে ছিল অন্য অন্য গাছ। দুটো আমড়া গাছ ছিল। এত মিষ্টি আমড়া আমি আর জীবনে কোথাও খাই নি। আম ফেলে আমড়া খেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না ----- এত মিষ্টি ! পানপুকুর আমার কাছে রহস্যের চাদরে মোড়া। সবসময় আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত। কিছুতেই তার ডাক ফেরাতে পারতাম না। কোনোদিন যদি দুপুরে কালবৈশাখীর ঝড় উঠত তাহলে আর দেখতে হতো না। পাড়ার সব ছেলে বিভিন্ন আমবাগানে গিয়ে হাজির হতো। পানপুকুরে খুব বেশি ছেলে আসত না। দিনের বেলাতেই বাগানের ভেতর অন্ধকার থাকত। এর অবশ্য একটা কারণ ছিল ----- এই পানপুকুরেই ডাক্তার দাদুর বড় ছেলে গলায় দড়ি দেয়। এই ঘটনা নিয়ে কত না ভূতের গল্প। তাই ছেলেরা এই পানপুকুরকে এড়িয়ে যেত। বাড়ির মা দিদির চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার অনেক সময় এই পানপুকুরে কেটেছে। মনখারাপ হলে চুপচাপ এখানে এসে বসে থাকতাম। সেইসময় চোখের সামনে কাদের দেখতাম আজ আর মনে পড়ে না। তবে একদিন আমার এক বন্ধু তার বাবা বদলি হয়ে যাওয়ার কারণে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। সেদিন খুব কেঁদেছিলাম এখানে বসে। একা একা। আবার একসময় নিজেকে বোঝাতে পেরেছিলাম এরকম তো হতেই পারে। বন্ধন তো ছিন্ন হবেই। সেদিন পানপুকুরের জল, হাওয়া, মাটি আমার সাথে ছিল। আর ছিল পথ, যার হাত ধরে প্রথম পানপুকুরে এসে পৌঁছেছিলাম। ~ হরিৎ :03/06/2017 *********************