পাঁচুর পাঁচালী অতনু দত্ত উচ্চ বন্ধুগণ, কি কি উর্ধমুখী? কুশল মঙ্গল তো? আপনাদের প্যাঁচা কূল শিরোমনি পন্ডিত পাঁচুর ঘাস-সবুজ অভিবাদন (সময়ের সহিত তাল মিলাইয়া চলিতে শিখিয়াছি, আগে হইলে কহিতাম সংগ্রামী অভিবাদন)। আমার প্রথম লাইন পড়িয়া ঘাবড়াইবার কোন প্রয়োজন নাই। আসলে গত পরশ্ব এক নবীন বিবিধ ডিগ্রীধারী বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত জ্ঞানী প্যাঁচার সহিত সাক্ষাৎ হইল। সে এই অধমকে সম্বোধন করিল “হাই আঙ্কল, হোয়াটস আপ?” ইংরাজী ভাষায় আমার জ্ঞান সীমিত হইলেও, শুনিয়াছি ইংরাজী অতি উচ্চ কোটির ভাষা। তাই যখন শুনিলাম ইংরাজীতে আজকাল ইহাই প্রথা, তখন আমিও তাহা ভাষান্তর করিয়া প্রয়োগ করিয়া ফেলিলাম আর কি। শুনিতে কষ্ট হইলে হউক, ইংরাজীতে লিখিতে গেলে দুই অক্ষরের তফাত থাকে তো থাকুক। কমপক্ষে চেষ্টা তো করিলাম। না হইলে, বাংলাভাষার যা দুরবস্থা! যত দিন যাইতেছে, ক্রমে ক্রমে ইহা বাংরেজি বা বান্দি ভাষায় পরিবর্তিত হইতেছে, ইদানীংকালে বাংরেন্দি বলিলেও বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। জানি বলিবেন, ভাষায় পরিবর্তন হইয়াই থাকে। অবশ্যই থাকে, কিন্তু যেই পরিবর্তনে মূল ভাষাটাই ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে অগ্রসর হয়, উহা কেমন পরিবর্তন? কিন্তু হায়, তাহা বুঝিবার ক্ষমতা কি আর কাহারো অবশিষ্ট আছে? হয়তো বলিবেন ছোট চঞ্চুতে বড় কথা বলিতেছি, বলিবেন “প্যাঁচাটার মাতা ঘেঁটে ঘ হয়ে গ্যাচে, ল্যাঙ্গুয়েজের খিল্লী করচে বে। আমাদের ল্যাঙ্গুয়েজ সালা বিসসো সেরা, নোবেল টোবেল পেয়েচে তাও জানেনা”, তাহাতে ক্ষতি নাই, শুধু বলিব একটু চক্ষু কর্ণ খুলিয়া চলিতে। আপনারা নাহয় কাটাইয়া দিলেন, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মকে যাহা উত্তরাধিকার সূত্রে দিয়া যাইতেছেন তাহা একটু বুঝিবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে ক্ষতি তো নাই। তাহারা বর্তমানে নিজেদের মধ্যে যে কথোপকথন করিয়া থাকে, সে মুখপুস্তিকা নামক সামাজিক ইয়েতেই হউক বা বাসে ট্রামে বিদ্যালয়ে মহাবিদ্যালয়ে বা ক্রীড়াঙ্গনেই হউক, আমি নিশ্চিত, আপনারা চেষ্টা করিলেও তাহার অর্ধভাগ শব্দের অর্থ অনুধাবন করিতে পারিবেন না। করিতে গেলে প্রভূত গবেষণার প্রয়োজন। যাহা বুঝিবেন তাহারও অর্ধ ভাগ বিজাতীয় ভাষায়। নব প্রজন্মের একটি বৃহদংশের বাক্যালাপ লক্ষ্য করিলে তাহাতে গুডডে বিস্কুটে ভগ্নকাজুর মতই বাংলা শব্দের উপস্থিতি পাইবেন। যাহা যদ্যপি বর্তমান, দর্শন পাওয়া যায় কিন্তু স্বাদ পাওয়া যায় না, তাহার আগেই জিহ্বায় মিলাইয়া যায়। শুনিতে বা খাইতে খারাপ লাগে না। যাহার বাংলা ভাষা বা গুডডে কাজু বিস্কুট নামেই বিপণন হয়, তথাপি স্বাদ যাহা পাই তাহা অন্য কিছু, নামানুসারে কদাপি নহে। সে যাহাই হউক, কি কহিতে গিয়া কি কহিলাম, সমস্ত কিছু কেমন প্যাঁচাইয়া গেল। আসলে তো প্যাঁচক, অতএব প্যাঁচানোই স্বাভাবিক। অদ্য যাহা লইয়া অধম প্যাঁচকের এই প্যাঁচালের অবতারণা তাহা আসলে ইংরাজীরই একটি অক্ষর। এক্স। ইহার সঠিক মাহাত্ম্য আমি অদ্যাবধি বহু চেষ্টা করিয়াও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। এই অক্ষরটির প্রতি প্রাচীন কাল হইতে মনুষ্যকূলের বিশেষ দুর্বলতার কথা সর্বজন বিদিত। যদিও সঠিক কারণ কি জানা নাই। তাহা কি তিনবার ইহার প্রয়োগে নাম প্রাপ্ত একটি বিশেষ শোণিত উষ্ণ করিবার মদিরার সুবাদে, না একই নামের কতিপয় নীল চলচ্চিত্রের প্রভাবে, নহে কি অঙ্কের একটি ভয়াবহ কাল্পনিক সংখ্যার নামকরণ ইহার নামে সেই কারণে, জানা নাই। তবে এইটুকু জানি যে এই অক্ষরটির সহিত কিঞ্চিত রহস্যের স্পর্শ অনাদি অনন্তকাল হইতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যেমন কোন পুরুষের ব্যাক্তিত্বে কোন বিশেষ কিছু না থাকিয়াও অনেক কিছু থাকিলে তাহাকে এক্স গুণক বা এক্স ফ্যাক্টর বলা হয়। আবার সেই পুরুষই যখন বান্ধবীর সুমিষ্ট পদাঘাত খাইয়া নিজ প্রকোষ্ঠে ল্যাদ খাইয়া থাকেন, তখন তাহাকে বান্ধবীটির এক্স বলা হয়। যদি কোন বস্তু বা শকট স্বাভাবিক গতি হইতে বেশী গতিতে ধাবন করিয়া থাকে তাহাকে এক্সপ্রেস বলা হয়। যেই রশ্মি আমার চিন্তাশক্তির ন্যায় নরম বস্তুর অভ্যন্তরে অনায়াসে প্রবেশ করিতে পারে অথচ কঠিন বস্তুতে আটকাইয়া যায় তাহাকে এক্স বা রঞ্জন রশ্মি বলা হয়। ইহার দ্বারা প্রাপ্ত চিত্রগুলি মনোরঞ্জন না করিলেও, কোনরূপ অতিরঞ্জন না করিয়া বলা যায় এই গুলিই মনুষ্যকুলের শ্রেষ্ঠ চিত্র। কারণ “ইয়ে অন্দর কি বাত হ্যায়”। আবার কোন সাধারণ (প্লেইন) বস্তুর পূর্বে ইহা না বসিলে তাহার বর্ননা (এক্সপ্লেইন) অসম্পূর্ণই থাকে। কাজেই গঞ্জিকা পুরাণের সূত্র মানিয়া সব মিলাইয়া এক্স রহস্য রহস্যই থাকিয়া যায়। কিন্তু আমার সমস্যা ইদানীংকালের আর একটি প্রভুত প্রচারিত শব্দ লইয়া। বাল্যকাল হইতে জানিতাম উত্তম বস্ত্র পরিধান করিয়া, হস্ত পদ এবং মুখমণ্ডলী বাঁকাইয়া চিত্রগ্রহনের উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হইলে তাহাকে পোজ বলা হয়। কিন্তু ইদানীংকালে জানিলাম সমাজের তথাকথিত সম্মানীয় ব্যক্তিদের সবস্ত্র সর্ব সম্মুখে চরিত্রের অন্তর্বাস পর্যন্ত খুলিয়া লওয়াকে এক্সপোজ বা কায়দা করিয়া কহিলে এক্সপোজেঁ বলে। স্বীয় অর্জুনবৃক্ষের মগডাল স্থিত তিন শয়নকক্ষের বাসস্থানে, প্রতি সায়াহ্নে স্বল্প গঞ্জিকা সেবনান্তে উপগ্রহ চালিত মূর্খ পেটিকা যাহাকে আপনারা টিভি বলিয়া থাকেন, আমি খুবই মনোযোগ দিয়া দেখিয়া থাকি। তাহাতে প্রতি সন্ধ্যায় যেই কলহপূর্ণ অনুষ্ঠান গুলি অনুষ্ঠিত হয় সেই অনুষ্ঠানে প্রত্যহ নিত্য নতুন এক্সপোজেঁ ঘটিয়া থাকে। কতিপয় সংবাদ প্রণালী প্রতিদিন ভাত ডাল খাইবার মতই, নিয়ম করিয়া এক্সপোজেঁ করিয়া যান, কিছু কলহপ্রিয় মনুষ্যরুপী প্রাণী সেই প্রনালীতে বসিয়া তাহা লইয়া সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির অথবা দেশের মাতা ভগিনী করিয়া যান। সেই প্রনালীর পরিচালক মহাশয় বা মহাশয়া সবাইকে প্রশ্ন করিয়া চলেন এবং কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়া স্বয়ং সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়া থাকেন। সেই সব এক্সপোজেঁ দেখিলে বুঝিতে হয় এই দেশে সৎ, চরিত্রবান ও সভ্য মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কমিয়া আসিয়াছে। যাহারা বাঁচিয়া আছেন তাহারাও এই সব অনুষ্ঠানের কল্যানে আর বেশীদিন টিঁকিবেন না। এক পরিচালক মহাশয় তো প্রতিদিন বলিয়া থাকেন “সমগ্র জাতি ইহা জানিতে চাহে” এবং খুবই নিশ্চিত ভাবে বলেন। এতই নিশ্চিত ভাবে যে আমারও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছে আমিও নিশ্চয় সমগ্র জাতির সহিত জানিতে চাহিয়াছি, কিন্তু নির্ঘাত গঞ্জিকা সেবনের কারণে স্মরণে নাই। সান্ধ্য মৌতাতে মত্ত আমি এইসব দেখিয়া প্রত্যহ শয়নপূর্বে মনে করি কল্য প্রভাত হইতে বুঝি দেশ বদলাইয়া যাইবে, কারণ সমস্ত অসামাজিক, দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিগ্রস্ত, ঠগ এবং তস্করের চিহ্নিতকরণ তো অদ্যই হইয়া গেল, অতএব কল্য নিশ্চিত ইহারা সবাই লৌহশলাকার পশ্চাতে, পশ্চাতে শলাকা লইয়া থাকিবেন, আর আমরা ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা ভারতবর্ষের বুকে শান্তিতে কালযাপন করিব। কিন্তু হায় প্রভাতের শীতল বায়ু অন্য কথা বলিয়া যায়। বলিয়া যায় সাধারণ প্যাঁচারা তো সেই তিমিরেই রহিয়াছে। যাহাদের এক্সপোজেঁ হইয়াছে তাহারা যথারীতি বক্ষাস্ফালন করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে আর সাধারণ প্যাঁচারা চারিদিকে উড়িয়া তাঁহাদের অভিনন্দন জানাইতেছে। আর মূর্খ পেটিকার সংবাদ প্রনালী গুলি তৃপ্তির উদগার তুলিয়া পরের এক্সপোজেঁর প্রস্তুতি লইতেছে। কাজেই নিত্য আমার সান্ধ্য মৌতাতে বৃথা এই বিঘ্ন ঘটাইবার কার্যক্রম চলিয়াছে প্রতিনিয়ত। তাই বাধ্য হইয়া ভাবিলাম সবাইকে জানাইবার কথা এবং আমার সবিনয় নিবেদন সকল সর্ব সাধারণের কাছে, আপনারা এই সকল এক্সেপোজেঁর কবল এবং দৌরাত্ম্য হইতে রক্ষা পাওয়ার কোন সদুপায় জানাইয়া এই ক্ষুদ্র প্যাঁচক এবং তাহার দুর্মূল্য মৌতাতকে রক্ষা করিয়া বাধিত করিবেন। ইতি আপনাদের একান্ত আপন পাঁচু ***************************************************************** অতনু দত্ত:03/06/2017