পথ —– ৩১
—————–
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের ব্রাহ্মণ বংশ খুব বড়। আমাদের গোটা পাড়াটা আমাদের আত্মীয়স্বজনেই
ভরা থাকতো। তাই একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু না কিছু অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো।
পারিবারিক অনেক অনুষ্ঠানবাড়িতেই আমরা নিমন্ত্রিত হতাম না। একটাই কারণ আমরা
অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। প্রত্যেক পরিবারের ছেলেমেয়েরাই কিছু না
কিছু করে ফেলেছে, একমাত্র আমি ছাড়া। এর জন্য বাবাকে অনেক কথা সহ্য করতে হতো।
অনুষ্টানবাড়িতে আমরা নিমন্ত্রিত হতাম না ঠিকই কিন্তু তাদের বাড়ির
আত্মীয়রা আমাদের বাড়িতে আসতে ছাড়ত না। আমাদের খোঁজ খবর নিতে নয়। বাড়ি বয়ে
আসত অপমান করতে।
বাবা হয়ত সেইসময় পুঁথি লেখায় ব্যস্ত। মাটির ঘর, খড়ের চাল দেখে তারা
বাবাকে বলত, ” তোমার আর কোনো উন্নতি হল না দাদা। ”
আমি দেখতাম বাবা শুধু হাসছে। কোনো রাগ নেই। বরঞ্চ তাদেরকে বাবা দুয়ারে
মাদুর পেতে বসতে দিচ্ছে।
বাবার মুখে শুনতে পেতাম, ” প্রস্তুতি চলছে। কবে কি হবে তা কি কেউ আগে থেকে
বলতে পারে? দেখা যাক না কি হয়। ”
ওরা চলে যেতে বাবাকে বলতাম, ” তুমি ওদের কথার প্রতিবাদ করো না কেন? ”
বাবা বলতো, ” কি হবে করে? ওদের দৃষ্টি দেখলে আমার কষ্ট হয়। আমার বাড়িতে
মাটির ঘর আর খড়ের চাল ছাড়া কি কিছুই দেখার নেই? আসলে ওদের চোখ নেই। কথা বলে
তো আর মানুষের চোখ ফোটানো যায় না। তাই চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। ”
পরে ভাবতাম সত্যিই তো। ওরা মনে মনে কত গরিব। পৃথিবীতে এতদিন রইলো অথচ চোখ
চেয়ে দেখতে শিখল না! আজ ভাবি পার্থিব সম্পদ একটা জীবনে সত্যিই প্রয়োজন আছে।
কিন্তু এটাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। পৃথিবীতে কত যে দেখার জিনিস।
একমাত্র প্রকৃত চক্ষুষ্মানেরাই সেই দৃশ্য দেখার অধিকারী হতে পারে। আমার
পিতৃদেব সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন ছিলেন। তাই অতি সামান্য রোজগারের মধ্যেও
মনে মনে রাজার মতো বেঁচে গেছেন।
হরিৎ~09/07/2017
*******************