মিলন পার্কের চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলেছে সৌমেন, সালেয়া তো কোনদিন এত দেরি করে না ,পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া লোকটির কাছে এককাপ চা নেয় সৌমেন ,বড় অস্থির অস্থির লাগে মনটা, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফিরে যায় সেই পুরনো অতীতে -বেশ রঙচঙে আজও সেই অতীত গুলো । সালেয়ার সেই তখন কলেজের শুরুর দিক....। কি অপরূপা ছিল সালেয়া সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে ,ধীরে ধীরে প্রেম কাছে আসা -আরও ঘনিষ্ট হওয়া --একটা সময় একে অপরকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারত না তারা ,সমাজ যে তাদের এই সম্পর্কটাকে মেনে নেবে না সেটা তারা জানত -কিন্তু একে অপরকে ছাড়া বাঁচা কঠিন এটাও তারা বুঝতে পারত । এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই চা-এর কাপের শেষ চুমুক টা দেয় সৌমেন ,না আর বসে থাকতে পারে না উঠে পরে.....,আস্তে আস্তে সালেয়ার ঘরের দিকে চলতে শুরু করে ,প্রায় ষাটের ঘরে পৌঁছে গিয়েছে দুজনেই -জীবনের এই শেষ গোধূলিতে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে নিজেদের বড় পরিপূরক বলে মনে হয় এখন। রোজ সকালে এই পার্কে এসে বসে দুজনে --সকালের চা-টা এখানেই খায় ওরা একসাথে। ভাবতে ভাবতে আবার সেই পুরনো দিনে ফিরে যায় সৌমেন -। শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে রেজিষ্ট্রিটাও করে ফেলে ছিল ওরা ,কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না -সালেয়া খুব ধনী পরিবারের মেয়ে ছিল -সৌমেন তখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি --সালেয়ার বাবা জোর করেই বিয়ে দিয়ে দেয় সালেয়ার --বিদেশী কোম্পানীতে চাকরি করা একটি ছেলের সাথে ,রাতারাতি ওদের বিদেশেও পাঠিয়ে দেয় । কিছুই করার ছিল না কারোর , যেন এই রকম কোন সম্ভবনার কথাই ওরা জানত। অনেক চেষ্টাও করেছিল জীবনটা একসাথে কাটানোর হয়ে উঠলোনা-। বিদেশে চলে যায় সালেয়া ,অনেক গুলো বছর অপেক্ষা করার পর সৌমেন ও বিয়ে করে শেষে ,একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে সৌমেনের স্ত্রী মারা যায়-,তারপর ওই মেয়েকে আশ্রয় করেই এগিয়ে চলে সৌমেনের জীবন। এদিকে সালেয়ার মা হয়ে ওঠা হয়নি -প্রায় গোটা জীবনটাই স্বামীর সাথে বিদেশে কাটিয়ে দেয় সালেয়া ,হঠাৎই একটা আক্সিডেংট এ স্বামী মারা গেলে --সালেয়া ফিরে আসে দেশে । এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সালেয়ার ঘরের দরজায় পৌঁছে গিয়েছে সৌমেন খেয়াল করেনি ,কি ভীষণ থমথমে চারিদিক -বাড়ির উঠোনে সাদা কাপড়ে ঢাকা শুয়ে আছে সালেয়া। সৌমেন আস্তে আস্তে সালেয়ার মরদেহের কাছে এগিয়ে যায় -নিঝুম ভাবে বসে থাকে ,সেই যেদিন স্বামীর মৃত্যুর পর সালেয়া ফিরে এল -হাঁ প্রায় দশ বছর আগে --সেদিন থেকে রোজ সকালে ওই পার্কে দেখা করত দুজনে ,তারপর যে যার নিজের কাজে যেত ,সৌমেনের মা মরা মেয়েটাকে বড় স্নেহ করত সালেয়া। নিজেই কন্যাদান করেছিল সৌমেনের মেয়ের বিয়েতে ---। হঠাৎই চোখে পরে সালেয়ার হাতে ওদের বিয়ের সেই রেজিষ্ট্রির কাগজ খানা। মুহুর্তেই সৌমেনের অসার শরীর খানা এলিয়ে পড়ে সালেয়ার বুকে....,এত গুলো বছরের চিরবিচ্ছেদ সমাপ্তিতে এসে মিলিত হয় আজ । শ্মশানের চিতায় সৌমেন যখন দাউদাউ করে জ্বলছিল ---কবরের শেষ মাটি চাপা পড়ছিল সালেয়া ॥ বৈশাখী চ্যাটার্জী:07/05/2017