পথ ----- ৩৪
-----------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামেই আমার জন্ম। গ্রামেই আমার বেড়ে ওঠা। আজ
পর্যন্ত চোখের সামনে শত শত গ্রাম দেখেছি। তবুও গ্রাম দেখার লোভ আমার আজও যায়
নি। মেঠো পথ দেখলেই আমার মন ছুটে যায়। মনে হয় একটু হেঁটে আসি। সবুজ আমার
প্রাণের, মনের আরাম।
পথে নামলেই আমি সবকিছু ভুলে যাই। পথের টানেই পা ছুটে চলে। তখন পথকে দেখার
আনন্দে আরও এগিয়ে যাই। যত এগিয়ে যাই ততই যেন পথের এক একটা পরত খুলে যেতে
থাকে। পথকে যেটুকু চিনে পথে নেমেছি তা যেন কয়েক পা হাঁটলেই ফুরিয়ে যায়।
মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় অভিজ্ঞতার ঝুলি।
পথকে আবিষ্কার করতে করতে এগিয়ে চলি। পথ চলার আনন্দেই জীবন থেকে মুছে যায়
দুঃখের বাষ্প। পথের সাথে যে পা মেলাতে পেরেছে তার আবার দুঃখ কিসের?
বাবাও পথকে ঠিক এইভাবেই চিনতে পেরেছিল। শত দুঃখেও সে কখনও কাতর হয় নি। শত
অভাবেও তাকে কখনও নুব্জ হয়ে যেতে দেখি নি। জীবনের অপ্রাপ্তি নিয়ে মানুষের কত
কিছু বলার থাকে, বাবাকে এই নিয়ে কখনও একটা কথা বলতে শুনি নি। সবেতেই সে খুশি।
হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়েই সে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।
কোনোদিন গুণে না দেখলেও বাবার অনেক ঘর যজমান ছিল। ধনেখালি থানার
অন্তর্ভুক্ত অনেক গ্রামেই বাবার যজমান ছিল। সাইকেলে করে গিয়ে দেখেছি সে
গ্রামের পথ শেষ হবার নয়। বাবা এইসমস্ত গ্রাম পায়ে হেঁটে হেঁটে যজমানি রক্ষা
করেছে।
সকাল ছ'টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাবা বাড়ি ফিরত সন্ধ্যে সাতটায়। এগুলো
প্রতিদিনের ঘটনা। বিশেষ বিশেষ পুজোর দিনগুলোতে বাড়ি ফিরতে আরও দেরি হতো।
মানুষ এতো পরিশ্রম করতে পারে কি করে! পরিশ্রমের চেয়েও যেটা বেশী করে আমাকে
ভাবাত সেটা হল বাবার ধৈর্য্য। একদিনের জন্যও তাকে আমি কখনও বিরক্ত হতে দেখি
নি। কখনও কোথাও থেকে এসে আমি তাকে রেগে যেতে দেখি নি।
মুখে কথা না বললেও বাবার আচরণে বুঝতে পারতাম, আমার কাজ তো আমাকেই করতে
হবে। কেউ তো এসে করে দেবে না। আমার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকেই। কাকে অভিযোগ
জানাতে যাবো? কিসের জন্যেই বা এই অভিযোগ? পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষ নিজের নিজের
কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমি তো তাদেরই একজন। তাহলে কাজের প্রতি আমার অনীহা থাকবে
কেন? কাজেই মানুষের পরিচয়। কাজেই মানুষের মনুষ্যত্ব, মানবিকতার প্রকাশ।
হরিৎ ~ 13/07/2017
***********************
Related